প্রথম আলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ বিস্তর। অভিযোগকারী পক্ষও অনেক। সবচেয়ে বড় অভিযোগ, প্রথম আলো কারও পক্ষে লেখে না। এই নির্লিপ্ততা, নিরপেক্ষতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা প্রথম আলোকে বিপুল পাঠকপ্রিয় করেছে। তারপরেও প্রথম আলো কার্যালয়ে ব্যাপক হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটল। এর কারণ কী, তার উত্তর নিশ্চয় সব পক্ষের কাছে একরকম হবে না।
প্রতিষ্ঠার পর প্রথম আলো ২৭ বছর পার করেছে। এ বছর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর বিশেষ প্রতিবেদনে পত্রিকাটির সম্পাদক মতিউর রহমান লিখেছেন, ‘প্রথম আলো একদিকে লাভ করেছে পাঠকদের ভালোবাসা, অন্যদিকে সব সময়েই, সব সরকারের আমলে, ক্ষমতাবানদের দমন-পীড়নের শিকার হতে হয়েছে এই প্রতিষ্ঠানটিকে।’ একই লেখায় তিনি জানিয়েছেন, যাত্রা শুরুর পর থেকে ১০০–এর বেশি মামলার মুখোমুখি হতে হয়েছে প্রথম আলোর সম্পাদক ও সাংবাদিকদের। বিগত সরকারের আমলে দেওয়া ৫২টি মামলার সুরাহা এখন পর্যন্ত হয়নি। বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও মামলা রুজু হয়েছে।
প্রায় দুই দশক আগে ফখরুদ্দীন আহমেদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে প্রথম আলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, তারা মাইনাস টু ফর্মুলা নিয়ে হাজির হয়েছে। তখন এ কথাও শোনা গেছে, মার্কিন এজেন্ডা বাস্তবায়নে বড় অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে প্রথম আলো। তার মানে প্রতিষ্ঠার আট-নয় বছরের মধ্যেই প্রথম আলো দেশীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নীতিনির্ধারণী ভূমিকায় হাজির হয়েছে!
সাম্প্রতিককালে কেউ কেউ প্রথম আলোকে ‘ভারতপন্থী’ হিসেবে অভিযুক্ত করেছেন। অথচ কী বিস্ময়কর, ভারতপন্থী হিসেবে আত্মস্বীকৃত আওয়ামী সরকারের প্রবল রোষের শিকার হয়েছিল এই পত্রিকা। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেছিলেন, ‘প্রথম আলো আওয়ামী লীগের শত্রু, গণতন্ত্রের শত্রু, দেশের মানুষের শত্রু।’ বিভিন্ন সূত্রে আমরা জেনেছি, প্রথম আলোকে ধ্বংস করার, এর মালিকানা নিয়ে নেওয়া ও সম্পাদক বদলের উদ্যোগও নেওয়া হয়েছিল। এনসিটিবিতে কাজ করার সময়ে দেখেছি, লেখক-সম্পাদকেরা প্রথম আলো থেকে যেসব ছবি বা তথ্য পাঠ্যবইয়ে ব্যবহার করেছিলেন, তখনকার শিক্ষামন্ত্রী, শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী কিংবা উচ্চপদস্থ কর্তাব্যক্তিদের নির্দেশে সেগুলো সব সরিয়ে ফেলা হয়েছিল। প্রথম আলোর বিরুদ্ধে কী আক্রোশ!
এ বছর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর স্লোগান ছিল ‘সত্যই সাহস’। প্রথম আলো সত্য প্রকাশ করতে বাধাগ্রস্ত হয়েছে, কিন্তু কখনো কুণ্ঠিত হয়নি। ইউটিউব, ফেসবুকের পাশাপাশি চারদিকে শত শত চ্যানেল আর সংবাদমাধ্যম। তারপরেও পাঠকেরা অপেক্ষা করেন প্রথম আলোর সংবাদের। কারণ, তাঁরা জানেন, প্রথম আলোর সংবাদ আর তথ্যের ওপর ভরসা করা যায়। চব্বিশের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময়ে যে কারণে প্রথম আলোর চাহিদা আরও ব্যাপকভাবে বেড়ে গিয়েছিল। দেশের যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনায় মানুষ প্রথম আলো থেকেই খবরের সত্যতা যাচাই করতে চায়। প্রথম আলোও তাই দায়িত্ব আর পেশাদারত্বের পরিচয় দিয়ে সংবাদ পরিবেশনে সচেষ্ট থাকে। প্রায় ক্ষেত্রেই একাধিক সূত্র থেকে যেকোনো বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে নেয়, তথ্য মিলিয়ে নেয়। তারপরও কোনো সংবাদে ভুল হলে অকপটে তার দায় স্বীকার করে, ভিন্নমত থাকলে প্রকাশ করে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও পুরস্কার প্রথম আলোর এ দায়িত্ববোধের স্মারক।
প্রথম আলো তরুণদের দিকেই সবচেয়ে বেশি মনোযোগী থেকেছে। এই তরুণেরাই আগামীর বাংলাদেশ গড়ার অগ্রনায়ক। প্রথম আলোর অধিকাংশ কর্মসূচি ও অনুষ্ঠান তরুণদের লক্ষ্য করেই পরিচালিত হয়। বাংলাদেশের প্রান্তিক পর্যায় পর্যন্ত তরুণেরা প্রথম আলোর বন্ধুসভার মাধ্যমে যুক্ত থেকে সামাজিক-সাংস্কৃতিক কাজ করে যাচ্ছেন। প্রথম আলো স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের নিয়ে গণিত অলিম্পিয়াড, ভাষা প্রতিযোগ, বিতর্কের মতো প্রতিযোগিতার আয়োজন করে থাকে। সামাজিক দায়বোধের জায়গা থেকে অ্যাসিডবিরোধী কর্মসূচি, মাদকবিরোধী আন্দোলন, সেরা তারুণ্য অনুসন্ধান, কৃতী শিক্ষার্থী সংবর্ধনা ইত্যাদি কার্যক্রমও চালিয়ে যাচ্ছে। প্রথম আলোর ‘পথ হারাবে না বাংলাদেশ’, ‘বদলে যাও, বদলে দাও’ ইত্যাদি স্লোগান এ সময়ের তরুণদের ব্যাপকভাবে উদ্দীপ্ত, উজ্জীবিত করেছে।
প্রথম আলো যেমন তরুণদের সামনে দেখতে চেয়েছে, তেমনি তরুণদের রাজনীতিকেও সামনে এনেছে। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের পতনের পর নতুন রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এনসিপি। এই দলকে সর্বসাধারণের কাছে পরিচিত করে তোলার জন্য প্রথম আলো প্রায় ক্ষেত্রেই প্রতিষ্ঠিত অন্য রাজনৈতিক দলের চেয়ে বেশি জায়গা দিয়েছে। আবার ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান হাদি গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর পরদিন ওপরের পাতার মোট সংবাদের অন্তত অর্ধেক জায়গা নিয়ে ছবি, অভিমতসহ ছেপেছে। প্রথম আলো এখন শুধু খবর পরিবেশন করে না, গুরুত্বপূর্ণ সংবাদের ভেতরের খবরও অনুসন্ধান করে প্রকাশ করে। দেখা গেছে, প্রথম আলোর অনেক সংবাদ তার দীর্ঘদিনের বন্ধু, সহযাত্রীর বিরুদ্ধে গেছে। কিন্তু সেখানেও প্রথম আলো সত্যের পক্ষে থেকেছে।