জেদ মানুষের একটি প্রাকৃতিক মানসিক গুণ অথবা বদ অভ্যাস। যা কখনো কাজে আসে, আবার কখনো বিপদ ডেকে আনে। জেদ ধরার শক্তি থাকলে মানুষ নিজের লক্ষ্য অর্জন করতে পারে কিন্তু যখন জেদ অযৌক্তিকভাবে বেড়ে যায়, তখন তা শুধু ব্যক্তির ক্ষতি করে না, সমাজের সুরক্ষিত প্রক্রিয়াকেও বিপন্ন করে। বাংলার প্রবাদ ‘জেদের ভাত কুকুরকে দিয়ে খাওয়ানো’ এই বাস্তবতাকেই সহজভাবে তুলে ধরে। ভাত রান্না করতে যে শ্রম ও যত্ন লাগে তা কুকুরের জন্য দেওয়ার প্রয়োজন নেই। কারণ, অনেক কুকুর ভাতে মোটেও সন্তুষ্ট নয়। তারা ভাতের চেয়ে কয়েকটি হাড় পেলে বেশি খুশি হয়। তাই প্রবাদটি যেমন জেদ ধরে নেওয়া সিদ্ধান্তের ফল তেমনি প্রাপ্য ব্যক্তি বা সমাজকে না পৌঁছিয়ে শয়তানি প্ররোচনায় অন্যদিকে নষ্ট করার নামান্তর।
আমাদের সমাজে রাজনৈতিক অঙ্গনে এই প্রবাদটি বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক। আমরা প্রায়ই দেখি কোনো রাজনৈতিক দল বা নেতা জেদ ধরে কোনো সিদ্ধান্ত নেন, আমরা যা বলেছি, সেটাই সঠিক। জনগণের প্রয়োজন, জনমতের যথার্থতা, সময়োপযোগী প্রক্রিয়া সবই বাদ পড়ে যায়। এমন জেদের ফলাফল হয় বিচ্ছিন্নতা, অস্থিরতা, এবং বিভাজন। ভোট, জনমত বা নীতি যা সমাজের জন্য মূল্যবান, তা হয়ে পড়ে অপ্রয়োজনীয় বা অপচয়। এমনকি বহু প্রতীক্ষিত জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষিত হলেও শুধু ক্ষমতায় যাবার মোহে আমাদের পারস্পরিক জেদ কমেনি এবং রাজনৈতিক মতভেদও দূরীভূত হয়নি।
সাম্প্রতিক সময়ে একাধিক উদাহরণ দেখা গেছে। কোনো এলাকায় সঠিক সময় বা প্রক্রিয়া বিবেচনা না করে ভোট আয়োজন করা হয়। রাজনৈতিক দলের জেদ, ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা বা নির্বাচনি কৌশলই সেই সময়কে প্রাধান্য পায়। ফলাফলে জনগণের আস্থা ক্ষুণ্ন হয়, ভোটার বিভ্রান্ত হয়, এবং রাজনৈতিক সংহতি নষ্ট হয়। একইভাবে, কোনো পরিবারে কোনো সদস্য জেদ ধরে অন্যের পরামর্শ উপেক্ষা করলে সম্পর্ক জটিল হয়। এক্ষেত্রে জেদের ভাত সত্যিই কুকুরকে খাওয়ানোর মতো শ্রম ও সম্পদ নিঃশেষ হয়, কিন্তু ফলাফল সঠিক প্রাপ্য ব্যক্তি বা উদ্দেশ্যে পৌঁছায় না।
শুধু রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নয়, সামাজিক ও কর্মক্ষেত্রেও জেদের প্রভাব স্পষ্ট। কোনো অফিসে বস্তুগত যুক্তি উপেক্ষা করে কর্মকর্তা জেদ ধরে সিদ্ধান্ত নিলে প্রকল্প ব্যর্থ হয়। স্কুলে শিক্ষক বা শিক্ষার্থী জেদ ধরলে শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট হয়। এমনকি পারিবারিক বা বন্ধু-বান্ধব সম্পর্কেও জেদের প্রভাব ধীরে ধীরে অনুভূত হয়। কারণ জেদ শুধু নিজস্ব মনোভাবকে প্রাধান্য দেয়, অন্যের অনুভূতি ও প্রয়োজনকে অন্যায়ভাবে উপেক্ষা করে।
সেদিন টেলিফোনে একটি জটিল নালিশ এসেছিল। সেটা একটি পারিবারিক বিশৃঙ্খলা জাতীয় মনো-সামাজিক সমস্যা। এর একটা ন্যায্য বিচার বা সালিশ করার জন্য বার বার ফোন আসতে থাকলো বিভিন্ন কর্নার থেকে। কিন্তু আমি তো কোন বিচারক নই। তবুও সবার দাবি আমিই নাকি পারবো এর সঠিক সমাধান করে দিতে।
অনেকের অনুরোধ শুনে বিপদে পড়ে গেলাম। কীভাবে কি করব, কীভাবে এর একটা সুষ্ঠু সমাধান হবে তা নিয়ে গভীর চিন্তা করতে থাকলাম। সেদিন পার হলো, পরের সাররাত ভাবনার অন্ত নেই। অতঃপর সেই সমস্যার প্রকৃত কারণ খুঁজতে তৎপর হলাম।
ঐ সমস্যার প্রৃকতি খুবই সাধারণ। তবে সেটা আমাদের সমাজের আর দশটা প্রচলিত পারিবারিক বিশৃঙ্খলার মতো নয়। যে কোনো সমস্যা হলে তার তার সমাধান অবশ্যই আছে। তবে সমস্যাক্রান্তকে সেই সমস্যা থেকে মুক্তি পাবার জন্য প্রবল ইচ্ছা পোষণ করে নানামুখী তৎপরতা চালাতে হয়। সমস্যাক্রান্ত ঘুমন্ত ব্যক্তির সমস্যা কখনই সমাধান করা যায় না।