সংকটাপন্ন হাদি, প্রশ্নবিদ্ধ জননিরাপত্তা
অনেক অনিশ্চয়তা ও সংশয়ের মধ্যে নির্বাচন কমিশন কর্তৃক আগামী জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার পরের দিনই দেশের রাজনৈতিক মঞ্চ উত্তপ্ত হয়েছে। এই উত্তাপ সৃষ্টি হয়েছে একটি মর্মান্তিক ঘটনাকে ঘিরে। শুক্রবার দুপুরে আকস্মিকই গুলিবিদ্ধ হয়েছেন জুলাই আন্দোলনের একজন সরব নেতা ও পরিচিত মুখ শরীফ ওসমান বিন হাদি। বর্তমানে তিনি অত্যন্ত সংকটজনক অবস্থায় চিকিৎসাধীন আছেন।
ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র হাদি যখন ঢাকা–৮ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ঘোষণা দেন, তখন তিনি সম্ভবত কল্পনাও করেননি যে মাত্র কয়েক দিনের মাথায় তার জীবন রাজনৈতিক সহিংসতার নির্মম শিকার হয়ে পড়বে। বিজয়নগরের ব্যস্ত দুপুরে প্রকাশ্যে মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে যখন তিনি অচেতন, তখন রাজনৈতিক বাস্তবতার একটি নির্মম সত্য আবারও সামনে এল, আগামী নির্বাচন আসলে কারও জন্য নিরাপত্তার নিশ্চয়তা নয়। অথচ গণতন্ত্রের মৌলিক ভিত্তি হলো প্রতিটি নাগরিকের নিরাপদে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার অধিকার। হাদি এখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে যাচ্ছেন, এবং তার এই অবস্থাকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একদিকে ক্ষোভ, নিন্দা, প্রতিবাদের ঢেউ উঠেছে, অন্যদিকে উল্লাসও দেখা গেছে অবলীলায়। কোনো মানুষের জীবন নিয়ে উল্লাস করার এই প্রবণতা আমাদের সমাজে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভয়াবহভাবে বেড়ে উঠেছে, যা সভ্য সমাজের মানবিক ভিত্তির ওপর সরাসরি আঘাত। হামলা, হত্যা, সন্ত্রাস কখনোই কোনো যুক্তিতে বৈধ হয় না। শত্রুরও জীবন থাকে, পরিবার থাকে, স্বপ্ন থাকে। কারও আহত হওয়া বা মৃত্যুকে কেন্দ্র করে আনন্দ করা মানুষের নৈতিকতা ও মনুষ্যত্বের বিপরীত, এবং হাদি–সংক্রান্ত প্রতিক্রিয়াগুলো দেখলে মনে হয় এই মৌলিক শিক্ষা যেন সমাজের একটি অংশ ভুলে গেছে।
হাদির ওপর হামলার ঘটনা নিছক একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; বরং গত ১৬ মাসে রাষ্ট্রে যে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটেছে তারই ধারবাহিকতা ও সম্প্রসারিত চিত্র যেন। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর জাতীয় জীবনে যেভাবে আশাবাদ তৈরি হয়েছিল, বাস্তবচিত্র তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়নি। স্বাধীন মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি (এইচআরএসএস) সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলছে, মাত্র এক বছরের ব্যবধানে রাজনৈতিক সহিংসতায় অন্তত ১৬০ জন নিহত হয়েছেন এবং আহতের সংখ্যা আট হাজারেরও বেশি। দেশজুড়ে এক হাজার ৪৭টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা নথিবদ্ধ করা হয়েছে, যার অধিকাংশই রাজনৈতিক সংঘর্ষ, সমাবেশে হামলা, দলীয় দ্বন্দ্ব বা শক্তির লড়াইয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত। এই পরিসংখ্যান শুধু সংখ্যার হিসাব নয়; প্রতিটি সংখ্যার পেছনে রয়েছে একেকটি পরিবারের হাহাকার, অসংখ্য মানুষের ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া ভবিষ্যৎ এবং নিরন্তর ভয়ের জীবন।
শুধু রাজনৈতিক সহিংসতাই নয়, সাধারণ অপরাধও আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। খুন, ছিনতাই, সংঘাত, ধর্ষণ, অপহরণ ইত্যাদি এখন প্রায় নিত্যদিনের ঘটনা। সবচেয়ে উদ্বেগজনক হলো অস্ত্র লুট ও অবৈধ অস্ত্রের স্রোত নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রের ব্যর্থতা। ২০২৪-এর জুলাই অভ্যুত্থানের সময় যেসব থানায় হামলা চালিয়ে অস্ত্র লুট করা হয়েছিল, অভ্যুত্থানের পর নতুন সরকার ক্ষমতায় তার খুবই ক্ষুদ্র অংশ উদ্ধার করতে পেরেছে। অবশিষ্ট অস্ত্র এখন কার হাতে আছে, কাদের স্বার্থে ব্যবহার হচ্ছে, কিংবা ভবিষ্যতে কোন সহিংসতার আগুনে এই অস্ত্র ঘি ঢালবে, সে সম্পর্কে জানতে পারা কঠিন।
নির্বাচনের আগে দেশের পরিস্থিতি অন্য যে কোনো সময়ের তুলনায় বেশি উত্তপ্ত হয়ে উঠতে পারে বলে মনে হচ্ছে। চারদিকে কেবলই অনিশ্চয়তার ছায়া। নির্বাচন কমিশন আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের ঘোষণা দিয়েছে, অথচ নির্বাচনি পরিবেশ এখন পর্যন্ত তীব্র অবিশ্বাস ও আতঙ্কের আবহে ঢাকা। অতীতের বিভিন্ন তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে যে সব নির্বাচন হয়েছে তখন সাধারণ মানুষ অন্তত কিছুটা স্বস্তি পেয়েছে যে, রাজনৈতিক বিবেচনার ঊর্ধ্বে উঠে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দৃঢ় অবস্থানে রয়েছে। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে সেই নিশ্চয়তা নেই। ভোটারদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে যে তারা ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার আগেই আক্রান্ত হন কিনা। প্রার্থীরাও এখন চিন্তিত প্রচারণায় নিরাপদ থাকবেন কি না এবং নির্বাচন আদৌ শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠিত হতে পারবে কিনা। হাদির ওপর হামলার ঘটনা এ উদ্বেগকে আরও ঘনীভূত করছে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এ সংকটকে আরও জটিল করে তুলেছে। একদিকে নাগরিকরা তথ্য ও মতামত প্রকাশের সুযোগ পাচ্ছেন, যা ইতিবাচক। কিন্তু অন্যদিকে একই মাধ্যমে ঘৃণা, মিথ্যাচার, অমানবিক উল্লাস এবং দলীয় বিদ্বেষ অপ্রতিরোধ্য গতিতে ছড়িয়ে পড়ছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, হাদির ওপর হামলাকে কেন্দ্র করে দুটি চিত্র স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
হাদির ওপর হামলার ঘটনায় এক পক্ষ আওয়ামী লীগ ও ভারতের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে একটা বয়ান তৈরির চেষ্টা করছে। এতে করে প্রকৃত অপরাধীরা আড়ালে চলে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। অন্যদিকে বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি কিংবা অন্য দলগুলো পরস্পরকে দোষারোপ করছে, সরকারের ব্যর্থতা তুলে ধরছে, আবার নিজেদের ওপর অভিযোগ এলেই তা অস্বীকার করে অন্য পক্ষকে দায়ী করছে। তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত ঘটনা খুঁজে বের করার আগেই এই পারস্পরিক দোষারোপ রাজনীতিকে অচল করে দিচ্ছে এবং জনগণের সামনে কোনো নিরাপত্তা বা গণতান্ত্রিক অগ্রগতির রূপরেখা স্পষ্ট হতে দিচ্ছে না। ক্ষমতার প্রতিযোগিতা যেন সহিংসতা ছাড়া আর কোনো পথে এগোতে পারছে না। বাস্তবে রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মীরা প্রার্থীদের ওপর হামলা করছে, একে অপরের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করছে, প্রতিপক্ষের মিছিলে হামলা চালাচ্ছে, আবার সেই সহিংসতা দায় প্রতিপক্ষের ওপর চাপাচ্ছে। ফলাফল হলো একটি গভীর অবিশ্বাসপূর্ণ পরিবেশ, যেখানে সাধারণ নাগরিকরা বিভ্রান্ত, আতঙ্কিত ও হতাশ।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সামনে রয়েছে বহুস্তরীয় সংকট। তারা কখনো কঠোর অবস্থান নিচ্ছে, কখনো নরম। কিন্তু ধারাবাহিকতা নেই। যে প্রশাসন নির্বাচনকে সামনে রেখে সঠিক সময়ে কঠোর ও নিরপেক্ষ ভূমিকা রাখতে পারে না, সে প্রশাসন দীর্ঘমেয়াদে শান্তি বজায় রাখতে পারে না। রাষ্ট্রীয় নির্দেশনায় নজরদারি বাড়ানো হয়েছে, অবৈধ সমাবেশ ও সহিংসতা রোধে কঠোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, কিন্তু বাস্তবে মাঠে সেই কঠোরতার কার্যকর প্রতিফলন দৃশ্যমান নয়। জনগণের মনে তাই সন্দেহ, রাষ্ট্র কি তাদের নিরাপত্তা দিতে পারবে?
এই প্রেক্ষাপটে হাদির ওপর হামলা একটি সতর্কবার্তা। এটি শুধু একটি ব্যক্তির ওপর আক্রমণ নয়, বরং দেশের নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হওয়া সহিংসতার সংস্কৃতির একটি প্রতীক। নির্বাচন সামনে রেখে বিভিন্ন মহলের চাপ, রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিযোগিতা, অন্তর্বর্তী সরকারের সীমাবদ্ধতা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দুর্বলতা, সব মিলিয়ে পরিস্থিতি এখন এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যে দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে সাধারণ মানুষ উদ্বিগ্ন হওয়াই স্বাভাবিক।
জনগণের আশা খুব বেশি নয়। তারা শুধু চায় একটি নিরাপদ ভোটকেন্দ্র, সহিংসতাহীন রাজনৈতিক পরিবেশ, মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং স্বচ্ছ প্রশাসনিক ভূমিকা। তরুণ সমাজ বিশেষভাবে হতাশ, কারণ তাদের জীবনের স্বপ্ন ও ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সহিংসতা কোনো মতাদর্শের অংশ নয়; এটি কেবল ক্ষমতালিপ্সার একটি প্রকাশ। যে রাজনীতি রক্ত চায়, সেই রাজনীতি কখনো দেশের উন্নতি ঘটাতে পারে না।