নির্বাচনের তফসিল: ভোট, জোট ও সংশয়

বিডি নিউজ ২৪ শুভ কিবরিয়া প্রকাশিত: ১২ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৮:৫০

জল্পনা-কল্পনা অবসান ঘটিয়ে ভোটের ফুল ফুটতে শুরু করেছে। মুহাম্মদ ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার ১৬ মাসের মাথায় জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করলো নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ভোটের তারিখ ঘোষিত হয়ে গেল। সদ্যঘোষিত তফসিল অনুসারে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে গণভোট হবে আগামী ১২ ফেব্রুয়ারি।


এই নির্বাচনে একজন ভোটার দুটি ব্যালটে ভোট দেবেন। সংসদের ভোটের ব্যালট হবে সাদাকালো; গণভোটের ব্যালট হবে রঙিন। গণভোটের ব্যালটে প্রশ্ন থাকবে–জুলাই জাতীয় সনদে বর্ণিত সংস্কার প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নে ভোটার সম্মতি দিচ্ছেন কি না। উত্তর দেওয়ার জন্য ব্যালটে ‘হ্যাঁ’ ও ‘না’ দুটো ঘর থাকবে। যারা সম্মতি জানাচ্ছেন তারা ‘হ্যাঁ’ লেখা ঘরে এবং যারা এর পক্ষে নন তারা ‘না’ লেখা ঘরে সিল ভোট দেবেন। ভোট দেওয়ার পর সংসদ এবং গণভোটের ব্যালট আলাদা দুটো বাক্সে ফেলতে হবে। একই দিন সংসদ ও গণভোট হওয়ায় এবার ভোটগ্রহণের সময় এক ঘণ্টা বাড়ানো হয়েছে। সকাল সাড়ে সাতটা থেকে বিকেল সাড়ে চারটা পর্যন্ত টানা ভোট গ্রহণ চলবে।


প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস তার কথা রাখলেন। এবার দেখা যাক গ্রহণযোগ্য ও আনন্দমুখর ভোট শেষ পর্যন্ত করা যায় কিনা? অবশ্য বল এখন রাজনৈতিক দলগুলোর কোর্টে। সুষ্ঠু নির্বাচনের বড় খেলোয়াড় এখন তারাই। তাদের ওপরেই নির্ভর করছে আগামী দিনের গণতান্ত্রিক উত্তরণের যাত্রাপথ। সেটা মসৃণ না কণ্টকময় হবে, নির্ভর করবে ছাত্রজনতার রক্তস্নাত গণঅভ্যুত্থানের পরে এই রাজনৈতিক রূপান্তরকে রাজনৈতিক দলগুলো কীভাবে পরিচালনা করে তার ওপর।


আপাতত রাজনৈতিক দলগুলোর চেষ্টা থাকবে নিজ নিজ দলকে ক্ষমতায় আনতে কে কিভাবে, কার সঙ্গে, কোন হিসাবে, ভোটের জন্য জোট গঠন করে সেটার ওপর। বড় দল বিএনপি সমমনাদের নিয়ে জোটের ঘোষণা না দিলেও ছোটদলের অনেক বড় নেতাদের নিয়ে নির্বাচনি ঐক্য গড়ার পথে রয়েছে। যদিও এক্ষেত্রে বড় বাধা নতুন সর্বশেষ সংশোধনীসহ গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ। এই গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের কারণে জোট করলেও রাজনৈতিক দলের নেতাদের নিজ নিজ প্রতীক নিয়েই নির্বাচন করতে হবে। জোটসঙ্গী হবার পরও বিএনপির নির্বাচনি প্রতীক ‘ধানের শীষ’ না পাবার বেদনা ও সংকট দুটোই বহন করতে হবে তার জোটসঙ্গীদের।


এরই মধ্যে ৯টি বাম দল নিয়ে গঠিত হয়েছে গণতান্ত্রিক যুক্তফ্রন্ট। জাপা ও জেপির নেতৃত্বে এসেছে নতুন জোট ‘জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট’। এনসিপি, এবি পার্টি ও রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন নিয়ে গঠিত হয়েছে ‘গণতান্ত্রিক সংস্কার জোট’। জামায়াতে ইসলামীসহ আটটি ইসলামপন্থী দলও আসন সমঝোতার বিষয়ে আলোচনা শুরু করেছে।


আসন্ন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ অনেকটাই অনিশ্চিত। কারণ দলটির কার্যক্রম নিষিদ্ধ রয়েছে। তাহলে এই অবস্থায় কী হবে দলটির? তাদের ভোটারদের অবস্থানই বা কী হবে। তবে আওয়ামী লীগের যাদের ভাবমূর্তি অপেক্ষাকৃত পরিচ্ছন্ন তাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ব্যাপারে সরকারের কোনো আপত্তি নেই বলে গুঞ্জন আছে। কিন্তু যাদের বিরুদ্ধে মামলা-মোকদ্দমা রয়েছে কিংবা মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা আছে তাদের কাউকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হবে না। দোদুল্যমান রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা আওয়ামী লীগের ভোট ব্যাংক সকল রাজনৈতিক দলের কাছে লোভনীয় হলেও সেই ভোট ব্যালট ও ভোটবাক্সে গড়াতে এখনো অনেক ‘যদি’ ও ‘কিন্তু’র ওপর নির্ভর করতে হবে।


তবে তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচনি আমেজ ফিরে আসলেও চলমান রাজনৈতিক ও সমাজ রূপান্তরে যেসব ঘটনা ঘটে গেছে তার প্রভাব পড়বে আগামী দিনের ভোটের রাজনীতিতে। আপাতত সেদিকে মনোযোগ দেওয়া যেতে পারে।


ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থান ও ফ্যাসিবাদি শাসকের পতনের পর রাজনীতিতে যে নৈতিকতার উম্মেষ ঘটবে বলে আশা করা গিয়েছিল, বাস্তবে ঘটেছে তার সম্পূর্ণ উল্টো ঘটনা। কি অন্তর্বর্তী সরকার, কী রাজনৈতিক দল, কি নাগরিক সমাজ-কারও আচরণেই সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক নৈতিকতার প্রাবল্য দেখা যায়নি। সমাজে চলছে নৈতিকতাহীন এক তীব্র অস্থিরতা ও অসহিষ্ণুতা। জনসাধারণের আচরণেও তার ব্যত্যয় নেই।


বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে অর্থের যে প্রবল অন্তর্মুখী সরবরাহ ঘটেছে তা আমাদের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য ঘটনা। বিআইডিএসের এক গবেষণা বলছে, অর্থনীতির এই বিকাশ শত বছরের গ্রামীণ ক্ষমতা কাঠামোকে যেমন নাড়িয়ে দিয়েছে, তেমনি সামাজিক মূল্যবোধ ও ভিত্তিকেও নাড়িয়ে দিয়েছে।


অনৈতিক উপায়ে অর্জিত সম্পদের যথেচ্ছ ব্যবহার ও প্রসারের অনিবার্য প্রভাব ক্ষমতা-কাঠামোর অস্তিতে আঘাত হেনে এর ভেতরের নৈতিক শক্তিকে দারুণভাবে পরাস্ত করেছে। ফলে মূল্যবোধহীন অনৈতিক এক রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতাকে আমরা হাজির পাচ্ছি।


বাংলাদেশ ইনসটিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস) আরেকটি গবেষণার তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে জানাচ্ছে গত চার দশকে বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে প্রবৃদ্ধি অর্জন এবং সামাজিক নানা সূচকে বিশেষ অগ্রগতি লাভ করলেও পিছিয়ে পড়া এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে যথাযথভাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফল বণ্টন হয়নি। এই অসাম্য সমাজের মধ্যে নানা মনস্তাত্ত্বিক বিভাজন তৈরি করেছে, জন্ম দিয়েছে সামাজিক অসন্তোষের।


বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে দেশে গত এক বছরে কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৯ হাজার। গত বছরের সেপ্টেম্বরে কোটিপতি আমানতকারী ছিল ১ লাখ ১৯ হাজার ১৫৪ জন, আর চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে এ সংখ্যা ১ লাখ ২৮ হাজার ৭০ জন। এক বছরে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা প্রায় ৭.৫ শতাংশ বেড়ে গেছে। দেশের অর্থনীতি ক্রমাগত চাপে, ব্যবসা স্থবির, শিল্পে সঙ্কোচন, মুদ্রাস্ফীতি উচ্চমাত্রায়, ব্যাংকিং খাতে অনিয়ম চরমে কিন্তু ঠিক এই সময়েই দেশে নতুন আরো ৯ হাজার কোটিপতি সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি অস্বাভাবিক। এটি নির্দেশ করে অর্থনীতিতে টাকার সুষম বণ্টন হচ্ছে না, বরং একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর কাছে কেন্দ্রীভূত হচ্ছে সম্পদ।


অর্থনীতি এখানে বিপরীতমুখীন। অর্থনীতির উৎপাদন অংশ সঙ্কুচিত, অথচ অদৃশ্য আর্থিক প্রবাহ বাড়ছে। সীমিত সংখ্যক মানুষ এক দিকে বিপুল সম্পদ জমাচ্ছে, অন্য দিকে জনসংখ্যার বড় অংশ টিকে থাকার লড়াইয়ে হিমশিম খাচ্ছে। এ প্রবাহ চলমান থাকার অর্থ হচ্ছে অর্থনীতি শুধু সঙ্কটেই নয়, সমাজও প্রবেশ করছে অনৈতিকতা-বৈষম্য-অস্বচ্ছ প্রবাহে। তৈরি হচ্ছে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের ঘনীভূত প্রবণতার। এটা দীর্ঘমেয়াদি অস্থিরতা ও স্থবিরতা সৃষ্টি করতে পারে।


সমাজ-রাষ্ট্রের এই ভয়াল ও গভীর ক্ষত যে অনৈতিকতার বার্তা বহন করছে তা ভোটের স্বাভাবিক সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করতে পারে বিপুলভাবে। ফলে ভোট কেনাবেচা, প্রার্থী কেনাবেচা, অস্ত্র ও পেশিশক্তি কেনাবেচার ঘটনা ভোটের বাজারকে উত্তাল ও উত্তপ্ত করতে পারে। সেটা আগামী দিনের রাজনৈতিক গণতান্ত্রিক রূপান্তরের পথ কতটা সুখকর করবে সেটা বলা মুশকিল।

সম্পূর্ণ আর্টিকেলটি পড়ুন

প্রতিদিন ৩৫০০+ সংবাদ পড়ুন প্রিয়-তে

আরও