উর্দু ভাষা ও সাংস্কৃতিক উপনিবেশবাদের পাঠ
মনুষ্যসভ্যতার অন্যতম পুরাতন যোগাযোগ মাধ্যম ভাষা। ব্যক্তি থেকে সমাজ, সমাজ থেকে রাষ্ট্র—মনুষ্যবিবর্তনের প্রতিটি পর্যায়ে একে-অপরের সঙ্গে যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম ছিল এই ভাষা। ভাষার এই মহতী পরম্পরা মনুষ্যসমাজে আজও জাজ্বল্যমান। কিন্তু ভাষার বড় দুর্বলতা হলো, ভাষার কোনো প্রাণ নেই। ক্রোধ নেই। ঘৃণা নেই। ভালোবাসাও নেই। মানুষ মূলত প্রয়োগের ধরন ও পরিপ্রেক্ষিতে ভাষার এই অসাধারণ মূল্য তৈরি করে। একই মন্তব্য সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও খাটে। সেক্ষেত্রেও দেখা যায় সেই ভাষাই মূলত অন্যতম পরিবাহীর ভূমিকা পালন করে। সংস্কৃতি প্রধানত নিজ জনগোষ্ঠীকেন্দ্রীক হলেও মানুষের মধ্য দিয়ে সংস্কৃতিও মানুষে মানুষে বা সমাজে সমাজে মেলবন্ধন তৈরি করতে সহযোগিতা করে।
কিন্তু সমস্যা হলো সেখানেই। ভাষা ও সংস্কৃতি যেহেতু পরিবাহী মানুষের ওপর নির্ভরশীল, তাই মানুষ নিজের স্বার্থ চরিতার্থের জন্য মাঝে মাঝে ভাষা ও সংস্কৃতিকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে সরল ভাষায় এই প্রক্রিয়াকেই বলা হয় ‘সাংস্কৃতিক উপনিবেশবাদ’ বা ‘সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদ’। প্রথমে ইউরোপের ভাষা ও সংস্কৃতি এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্রের ভাষা ও সংস্কৃতি হয়ে ওঠে এই ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণের অন্যতম হাতিয়ার। ফলে, বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে পাশ্চাত্যকেন্দ্রিক ভাষা ও সংস্কৃতি হয়ে ওঠে সাংস্কৃতিক উপনিবেশবাদ বা সাম্রাজ্যবাদের মূল কেন্দ্রবিন্দু।
এডওয়ার্ড সাঈদ তার ওরিয়েন্টালিজম ধারণার মাধ্যমে কলোনিয়ালিজমের চিন্তার বিকাশ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তার দৃষ্টিতে কলোনিয়ালিজমের শুরু হয় ‘ওরিয়েন্ট’ সম্পর্কে ‘অক্সিডেন্ট’-এর নিজস্ব ও অতিরঞ্জিত ধারণা তৈরির মাধ্যমে। সাঈদের মতে ‘ওরিয়েন্ট’ সম্পর্কে এই ধারণা তিনভাবে প্রতিষ্ঠা পায়। প্রথমত, এটি একটি ‘চিন্তার ধরন’ হিসেবে। পাশ্চাত্যমুখী গবেষণা ও প্রতিষ্ঠান তৈরির মাধ্যমে এই ধারণা লালিত হয়। দ্বিতীয়ত, এই চিন্তা লালনের মাধ্যমে ‘আমরা’ ও ‘তারা’ এই ধারণার সূত্রপাত হয়। যা ধীরে ধীরে শোষণের হাতিয়ার হয়ে ওঠে। তৃতীয়ত, একপর্যায়ে উৎকৃষ্ট ‘আমরা’ই হয়ে ওঠে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার অন্যতম হাতিয়ার। সাঈদের এই দর্শন পাশ্চাত্যভিত্তিক ঔপনিবেশিক চিন্তা ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার ইতিহাস বর্ননা করে। কিন্তু সেটিই একমাত্র নয়।
তিনি এই ধারণা বিকাশের ইতিহাসকে তিনটি মূল পর্বে ভাগ করেন। তার বিশ্লেষণে প্রথম পর্ব শুরু হয় হোমারের যুগ থেকে। যা বিস্তৃত ছিল ১৮শ শতাব্দী পর্যন্ত। সাঈদ তার ওরিয়েন্টালিজম বইয়ে লিখেছেন অ্যাসকালাস এর ‘দ্য পারসিয়ান্স’ বা হোমারের ‘দ্য ট্রোজান হর্স’-এর বর্ণনায় প্রথম এই ধারণার উল্লেখ পাওয়া যায়। ওই যুগে ‘আমরা’ ও ‘তারা’ ধারণার মূল পরিচালক ছিল পরাক্রমশালী গ্রিস। এই ধারণার দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয় ১৮শ শতকে–যা চলতে থাকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত। এই সময়ে মূলত ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য এই ধারণার মূল পৃষ্ঠপোষক ছিল। আর তৃতীয় বা বর্তমান অবধি চলমান পর্বের নিয়ন্ত্রণ একমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের হাতে। এই পর্বে যুক্তরাষ্ট্র মূলত ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের কৌশল অবলম্বন করে। এই সময়ে ওরিয়েন্টের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে আরব জাতিগোষ্ঠী ও তাদের সংস্কৃতি। যুক্তরাষ্ট্র তার শক্তিশালী গণমাধ্যম ও যোগাযোগব্যবস্থার মাধ্যমে এই ধারণা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে। ধীরে ধীরে যা হয়ে ওঠে বিশ্ব শোষণ ও শাসনের হাতিয়ার। যে প্রক্রিয়া আজও জিইয়ে রেখেছে।
ভাষা ও সংস্কৃতির এই সুন্দর মেলবন্ধন তখনই অন্যের শোষণের হাতিয়ার হয়ে ওঠে যখন সেটি ক্ষমতা চর্চা ও আধিপত্য বিস্তারের সঙ্গে যুক্ত হয়। এখন যদি উর্দু ভাষা ও সংস্কৃতিকে বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে এই দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়ন করি, তাহলে কী দেখতে পাই? ওই সম্পর্ক কী বন্ধুত্বের নাকি শোষণের? ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিদায়ের পর মোটাদাগে ধর্মের ভিত্তিতে এই অঞ্চলের মানুষ দুটো দেশ পায়। একটি হিন্দু অধ্যুষিত ‘ভারত’, যদিও ভারত নিজেদের সেক্যুলার রাষ্ট্র বলে ঘোষণা করে; অন্যটি মুসলিমপ্রধান ‘পাকিস্তান’। ধর্মের ভিত্তিতে দুটি দেশ তৈরি হলেও সেখানে বসবাস ছিল নানান ভাষা, সংস্কৃতি ও বর্ণের মানুষের। ছিল অন্যান্য আরও অনেক ধর্মভিত্তিক জাতি। কিন্তু এই পার্থক্যই যেন কাল হয়ে ওঠে।
দুই দেশেই জনগোষ্ঠীর মধ্যে ‘আমরা’ ও ‘তারা’ বিভেদের দেয়াল বাড়তে থাকে। ভারতে সেটির এক ধরনের সুরাহা হলেও পাকিস্তানে এই ‘আমরা’ ও ‘তারা’ বিবেধ প্রকট আকার ধারণ করে। বিশেষ করে উর্দু ও বাংলা ভাষাভাষীদের মধ্যে। উর্দু ভাষা ও সংস্কৃতি শাসকের ভাষা ও সংস্কৃতি হওয়ার কারণে এটিই হয়ে ওঠে বাংলা ভাষা-সংস্কৃতির মানুষকে শোষণের অন্যতম হাতিয়ার। ফলে একই দেশের নাগরিক হওয়ার পরও উর্দু ভাষাভাষীরা বাংলা ভাষাভাষীদের সঙ্গে ঔপনিবেশিক আচরণ করতে থাকে। দেখা যায় তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী উর্দু ভাষা ও সংস্কৃতি বাংলার মানুষের ওপর চাপিয়ে দিতে প্রবল কর্তৃত্ববাদী প্রচেষ্টা চালায়। বাংলা অঞ্চলের মানুষের প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও ১৯৪৮ সালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তার ঢাকা সফরের সময় উর্দুকে তৎকালীন পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা দেয়। প্রথম ২১ মার্চ ঢাকায় একটি মিটিংয়ে এবং এর দুদিন পর ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয়ের এক বিশেষ কনভোকেশনে জিন্নাহ উর্দুকে তৎকালীন পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা দেয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষণের পর ২৪ মার্চেই জিন্নাহ বাংলা ভাষার দাবি নিয়ে কাজ করা তৎকালীন ‘কমিটি অব অ্যাকশন’-এর নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বসেন। পরবর্তীতে ওই কমিটির আহ্বায়ক কামরুদ্দীন আহমদ লিখেছেন, সেখানে তারা জিন্নাহর উর্দু ভাষার দাবির বিপরীতে পাল্টা যুক্তি দেন। একটি স্থায়ী সরকারের জন্য যে একক ভাষা কতটা জরুরি তা বোঝাতে জিন্নাহ যুক্তরাষ্ট্রের ইংরেজি ব্যবহারের উদাহরণ দেন। এর পাল্টা যুক্তি হিসেবে কমিটির সদস্যরা তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও সুইজারল্যান্ডের উদাহরণ দেন। কারণ, তখন পাকিস্তানের ৫৬ শতাংশ মানুষের ভাষা ছিল বাংলা। কমিটির সদস্যরা আরও বলেন, যদি দুটি ভাষা করা না হয় তাহলে উর্দুও না বাংলাও না বরং ইংরেজি হবে সেই একমাত্র ভাষা।
উর্দুকে একমাত্র ভাষা ঘোষণার কারণ হিসেবে জিন্নাহ বলেন, ‘উর্দু হবে পাকিস্তানের লিঙ্গুয়া ফ্রাংকা’। জিন্নাহ আরও বলেন, উর্দু ভাষা ও সংস্কৃতি ‘এই উপমহাদেশের একশ মিলিয়ন মুসলিম চর্চা করে’ এবং ‘এই ভাষা অন্যান্য মুসলিম দেশের ভাষার কাছাকাছি’। এই যুক্তির মূল লক্ষ্য ছিল ধর্মকে ব্যবহার করে পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলা ভাষাভাষির ওপর উর্দুকে চাপিয়ে দেওয়া। এই যুক্তির মাধ্যমে জিন্নাহ ধর্মপ্রাণ বাঙালি মুসলিমদের অনুভূতি জাগাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতার ওই স্বল্প সময়ে উর্দু ভাষা ও সংস্কৃতি বাংলার মানুষের বিরুদ্ধে যে একটি শোষণের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে সেটি তিনি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেছিলেন।
- ট্যাগ:
- মতামত
- আগ্রাসন
- উর্দু
- সাংস্কৃতিক