সীমান্ত ভূমিতে রক্তলাল নদী বহমান
সীমান্তের সেই অদৃশ্য রেখা, যা দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে বন্ধুত্বের সেতু হওয়ার কথা ছিল, তা কখনো কখনো রক্তাক্ত নদীর মতো বইতে থাকে। ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) বাংলাদেশ সীমান্তে ঘটমান বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডগুলো শুধু সংখ্যার খেলা নয়, বরং অসংখ্য পরিবারের অশ্রুসিক্ত কাহিনী।
১৯৭১ সালের স্বাধীনতার পর ৪ ডিসেম্বর ২০২৫ পর্যন্ত এ রক্তপাতের মূলে রয়েছে অর্থনৈতিক অসমতা, চোরাচালান এবং অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের ‘ট্রিগার হ্যাপি’ মানসিকতা। কুলাউড়া উপজেলার সুখিরাম উরাং-এর মতো সাম্প্রতিক হত্যা এ চক্রকে আরও জ্বালাময়ী করে তুলেছে। মৌলভীবাজারের কুলাউড়া সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে সুখিরাম উরাং (২৫) নামের বাংলাদেশি এক তরুণ নিহত হয়েছেন। বৃহস্পতিবার দুপুরে উপজেলার কর্মধা ইউনিয়নের মুরইছড়া সীমান্তে এ ঘটনা ঘটে। নিহত সুখিরামের বাড়ি কর্মধার মুরইছড়া বস্তি এলাকায়।
স্থানীয় লোকজনের বরাতে কুলাউড়া থানা-পুলিশ জানায়, সুখিরাম বেলা দেড়টার দিকে মুরইছড়া সীমান্তের ১ হাজার ৮৪৪ ও ১ হাজার ৮৪৫ নম্বর মূল সীমান্ত খুঁটি এলাকায় গরু চরাচ্ছিলেন। একপর্যায়ে বিএসএফ তাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। এতে তার পিঠে গুলি লাগলে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। পরে আশঙ্কাজনক অবস্থায় কুলাউড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়ার পথে তিনি মারা যান। খবর পেয়ে পুলিশের একটি দল হাসপাতালে গিয়ে তার লাশ উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায়। এ রক্তের নদীকে শান্তির স্রোতে রূপান্তরিত করতে সত্যিকারের সংলাপ অপরিহার্য।
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত প্রায় ৪,০৯৬ কিলোমিটার দীর্ঘ, যা ভারতের পাঁচটি রাজ্য-পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা ও মিজোরামের সঙ্গে বিস্তৃত। এ সীমান্ত নদী, পাহাড় ও সমতল ভূমির সমন্বয়ে গঠিত একটি জটিল রেখা। মানচিত্রের মাধ্যমে এ সীমান্ত অঞ্চলটি ভালোভাবে বোঝা যায়, যেখানে পশ্চিমবঙ্গ প্রায় ২,২১৭ কিমি. ত্রিপুরা ৮৫৬ কিমি. মিজোরাম ৩১৮ কিমি. মেঘালয় ৪৪৩ কিমি. এবং আসাম ২৬২ কিমি. সীমান্ত ভাগ করে নিয়েছে। এ সীমান্তটি একদিকে যেমন অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের কেন্দ্র, তেমনই কিছু বিতর্কিত এলাকাও রয়েছে, যেমন সাতক্ষীরা জেলার হাড়িয়াভাঙ্গা নদীর মোহনায় অবস্থিত দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপ। লালবৃত্ত দ্বারা চিহ্নিত সীমান্তবর্তী জেলাগুলো উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ।
উল্লেখযোগ্য হত্যাকাণ্ডের বছরভিত্তিক তালিকা
২০১১ সালে ফেলানি খাতুন (১৫ বছর কিশোরী), কুড়িগ্রাম সীমান্তে গুলিবিদ্ধ হয়ে দেহ কাঁটাতারে ঝুলে থাকে বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করে। ২০২৪ সালে স্বর্ণা দাস (১৩ বছর), ত্রিপুরায় নিহত, যা আইসিসি-তে মামলার দাবি ডেকেছে। ২০২৫ সালে আব্দুর রহমান (সিলেট, সেপ্টেম্বর), ত্রিপুরায় ৩ জন (অক্টোবর); পাশুরাম সীমান্তে ২ জন (জুলাই); চুয়াডাঙ্গায় কৃষক (জুলাই); মৌলভীবাজার কাসবায় মোহাম্মদ আল-আমিন (ফেব্রুয়ারি); সুখিরাম উরাং (কুলাউড়া, ০৪ ডিসেম্বর) অধিকাংশই অস্ত্রহীন।
সীমান্ত চুক্তি এবং তাদের ব্যর্থতা
১৯৭৫ : যৌথ সীমান্ত নির্দেশিকা, অ-মারাত্মক অস্ত্রের প্রতিশ্রুতি কিন্তু লিথাল ফোর্স অব্যাহত।
২০১১ : কো-অর্ডিনেটেড বর্ডার ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান (সিবিএমপি), যৌথ পাহারা এবং ‘জিরো কিলিং’ লক্ষ্য ব্যর্থতা : তথ্য আদান-প্রদান দুর্বল।
২০১৫ : ল্যান্ড বাউন্ডারি অ্যাগ্রিমেন্ট (এলবিএ), এনক্লেভ বিনিময় সীমান্ত সরল হলেও হত্যা অব্যাহত।
২০১৮ : অ-মারাত্মক অস্ত্র চুক্তি, লিথাল ফোর্স কমানোর প্রতিশ্রুতি ব্যর্থতা কোনো বিএসএফ সদস্যকে বিচার করা হয়নি, যা দায়মুক্তি সৃষ্টি করে।
বিএসএফের মারমুখী আচরণ এবং মদ্যপানের ঘটনা, বিএসএফের ‘ট্রিগার হ্যাপি’ মানসিকতা এবং ‘শুট-টু-কিল’ নীতি পিঠে গুলি করে পালানোদের হত্যা করে। মদ্যপান অবস্থায় কর্তব্যের ঘটনা (যেমন-২০২৪-এ লালমনিরহাটে একটি হত্যায়) অতিরিক্ত বলপ্রয়োগকে আরও ভয়াবহ করে। এইচআরডব্লিউয়ের রিপোর্টে বলা হয়েছে, এগুলো এক্সট্রাজুডিশিয়াল কিলিং।
ভারত সরকারের উদাসীনতা এবং চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়া, ভারত সরকার এগুলোকে ‘দুর্ভাগ্যজনক’ বলে উড়িয়ে দেয়, কিন্তু তদন্ত করে না। দায়মুক্তি আইন সুরক্ষা দেয়, যা হত্যা অব্যাহত রাখে। চুক্তিগুলোর বাস্তবায়ন দুর্বল, যেমন ২০১৮ চুক্তির পরও হত্যা বেড়েছে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- সীমান্ত হত্যা