দারিদ্র্য মানুষকে মহান করে না
কাজী নজরুল ইসলাম তার ‘দারিদ্র্য’ কবিতায় দারিদ্র্যকে একটি মহিমান্বিত শক্তি হিসেবে চিত্রিত করেছেন, যা মানুষকে সত্য কথা বলার ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার সাহস জোগায়। কবি ব্যক্তিগত জীবনের চরম দারিদ্র্যকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখেছেন এবং এর বহুমাত্রিক প্রভাব তুলে ধরেছেন।
কবি দারিদ্র্যকে ‘হে দারিদ্র্য, তুমি মোরে করেছ মহান’ বলে সম্বোধন করেছেন। তিনি মনে করেন, দারিদ্র্য মানুষকে চারিত্রিক দৃঢ়তা এবং মহত্ত্ব দান করে, যেমন খ্রিষ্টকে কাঁটার মুকুট সম্মান দিয়েছিল।
দারিদ্র্য কবিকে ‘অসংকোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস’ এবং ‘উদ্ধত উলঙ্গ দৃষ্টি’ দিয়েছে। ফলে তিনি সমাজের ভণ্ডামি ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে নির্ভীকভাবে কথা বলতে পেরেছেন।
ব্যক্তিগত দুঃখের ঊর্ধ্বে গিয়ে কবি সমাজে বিদ্যমান ধন-বৈষম্য, ক্ষুধা ও মানুষের দুঃখ-কষ্টের প্রতি গভীর সংবেদনশীলতা প্রকাশ করেছেন। তিনি দরিদ্র ও শোষিত মানুষের পক্ষে কথা বলেছেন। নজরুল ‘দারিদ্র্য’ কবিতায় দারিদ্র্যকে কেবল বঞ্চনা হিসেবে না দেখে, বরং এটিকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে এবং জীবন ও সমাজের নির্মম সত্যকে সাহসের সাথে প্রকাশ করার এক অনুপ্রেরণামূলক শক্তি হিসেবে তুলে ধরেছেন।
কিন্তু কথা হচ্ছে, সবাই কবি কাজী নজরুল নন। দারিদ্র্যকে ইতিবাচক হিসেবে নেওয়ার সক্ষমতা সবার থাকে না। তাই দারিদ্র্য তাদের কাছে চরম লাঞ্ছনা, বঞ্চনা ও নির্মমতার বিষয়। এ কারণেই দারিদ্র্য তাদের মহান করে না। কেননা ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়।
দারিদ্র্য হলো এমন একটি অর্থনৈতিক অবস্থা যেখানে একজন ব্যক্তি বা পরিবার তাদের মৌলিক চাহিদা যেমন খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পূরণের জন্য পর্যাপ্ত আয় করতে পারে না। এটি একটি জটিল অবস্থা, যা প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অর্থনৈতিক মন্দা, সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যা এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির মতো বিভিন্ন কারণে সৃষ্টি হতে পারে। দারিদ্র্যের বিভিন্ন রূপ আছে, যেমন- পরম দারিদ্র্য (চরম অভাব) এবং আপেক্ষিক দারিদ্র্য (অন্যের সাপেক্ষে অভাব)।
নানান কারণে দারিদ্র্য বাড়ছে। এর মধ্যে রয়েছে অর্থনৈতিক দুর্দশা, চাকরির অভাব এবং আয় বৈষম্য। সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণেও বাড়ছে দারিদ্র্য। দুর্নীতি, অদক্ষ শাসন এবং পর্যাপ্ত অবকাঠামোর অভাব এজন্য দায়ী।
বন্যা, খরা, জলোচ্ছ্বাস ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগও দারিদ্র্য সৃষ্টি বা বাড়তে পারে। অতিরিক্ত জনসংখ্যা দারিদ্র্যের অন্যতম কারণ হতে পারে। বাংলাদেশে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের কার্যক্রম অনেকটা ঝিমিয়ে পড়েছে। এ ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষে নেওয়া অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে।
মৌলিক চাহিদা পূরণে অক্ষমতা জীবনযাত্রার মানকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করে। দারিদ্র্যের কারণে স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার সুযোগ সীমিত হয়ে পড়ে। মানুষ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকে এবং সহজে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যেতে পারে দারিদ্র্যের কারণে।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস দারিদ্র্যকে জাদুঘরে পাঠানোর কথা বলছেন বেশ জোরেশোরেই। তার ‘থ্রি জিরো তত্ত্বেও’ সবার আগে শূন্য দারিদ্র্যের কথা বলা হয়েছে। ‘থ্রি জিরো তত্ত্ব’ হলো ড. মুহাম্মদ ইউনূস কর্তৃক প্রস্তাবিত একটি সামাজিক-অর্থনৈতিক মডেল, যার মূল লক্ষ্য তিনটি ‘শূন্য’ অর্জন করা: শূন্য দারিদ্র্য, শূন্য বেকারত্ব এবং শূন্য নেট কার্বন নিঃসরণ। এই তত্ত্বের উদ্দেশ্য হলো- প্রচলিত পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বাইরে গিয়ে একটি টেকসই ও শোষণমুক্ত বিশ্ব গড়ে তোলা, যেখানে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের মাধ্যমে এই তিনটি লক্ষ্য একসাথে পূরণ করা সম্ভব হবে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে তার শাসনামলেই দারিদ্র্যের হার বেড়েছে। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার বেড়ে প্রায় ২৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এ সংখ্যা অনুপাতে প্রায় ৪ কোটি মানুষ বহুমাত্রিক দারিদ্র্যের শিকার।
- ট্যাগ:
- মতামত
- দারিদ্র্যতা
- প্রাকৃতিক দুর্যোগ
- বৈষম্য