স্কুল-কলেজে ভূমিকম্প প্রস্তুতি মহড়া চালু হোক
মাধবদীতে নভেম্বর ২১, ২০২৫ তারিখের সৃষ্ট ভূমিকম্প আমাদের আবারও দেখিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ ভূমিকম্প ঝুঁকির এক নতুন যুগে প্রবেশ করেছে। একসময় মনে করা হতো বড় ধরনের কম্পন আমাদের এখতিয়ারে পড়বে না। কিন্তু গত এক দশকে ঢাকা, ময়মনসিংহ, সিলেট ভূ-অঞ্চলের সক্রিয়তা সেই ধারণাকে সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণ করেছে। এই বাস্তবতায় সবচেয়ে ঝুঁকির মুখে আছে স্কুল–কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশু-কিশোররা। যারা বিপদের মুহূর্তে কী করবে, কোন পথে বেরোবে, কীভাবে মাথা বাঁচাবে এসব বিষয়ে প্রায়ই অনভিজ্ঞ। তাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বার্ষিক দুইবার বাধ্যতামূলক ভূমিকম্প প্রস্তুতি মহড়া চালুর দাবিটি আর কোনো অহেতুক বিলাসিতা করার অনুষ্ঠান মনে না করে এটাকে জরুরি জাতীয় প্রয়োজন মনে করে অতি দ্রুত চালু করা উচিত। কারণ ভূমিকম্পপ্রবণ অনেক দেশে জীবনরক্ষামূলক এই ধরনের কর্মসূচি চালু রয়েছে।
বিশ্বের যে-সব দেশ ভূমিকম্প-ঝুঁকিপূর্ণ যেমন: জাপান, নেপাল, ফিলিপাইন, ভানুয়াতু, ইন্দোনেশিয়া তারা স্কুল পর্যায়েই বছরে একাধিক মহড়া বাধ্যতামূলক করেছে। কারণ শিশুরাই সবচেয়ে দ্রুত শেখে এবং বিপদে আচরণ পুনরাবৃত্তি করতে পারে। ওই দেশগুলোতে মহড়া মানে আনুষ্ঠানিকতা নয়; বরং বাস্তব পরিস্থিতির কাছাকাছি গিয়ে ঝুঁকি চিহ্নিতকরণ, নিরাপদ আশ্রয় ব্যবহার ও উদ্ধারপথ অনুশীলন। বাংলাদেশেও প্রয়োজন ঠিক এমনটাই।
তবে গোটা বিশ্বের দিকে তাকালে সবচেয়ে অনুকরণীয় উদাহরণ হলো জাপান। বিশ্বের অন্যতম ভূমিকম্পপ্রবণ দেশটি বারবার বিধ্বস্ত হয়েছে, কিন্তু প্রতিটি ধাক্কাকে তারা রূপান্তর করেছে আরও উন্নত প্রস্তুতিতে। সেখানে শিশুদের প্রথম পাঠগুলোর একটি হলো ‘জিশিন দুরিলু’ বা ‘Earthquake Drill’ যা শুধু মনে রাখার জন্য নয়, প্রতিনিয়ত অনুশীলনের জন্য। স্কুলগুলোতে বছরে একাধিক মহড়া হয়ে থাকে যেখানে শিক্ষার্থীরা জানে কীভাবে ‘Drop Cover Hold’ করতে হয়, কীভাবে আতঙ্ক নিয়ন্ত্রণ করতে হয় এবং কোন কোন নির্গমনপথ সবচেয়ে নিরাপদ।
মজার ব্যাপার হলো জাপানে মহড়া মানে শুধু সাইরেন বাজানো নয় বরং একটি পূর্ণাঙ্গ সিমুলেশন। জানালা খোলা-বন্ধ শেখানো, টেবিলে বা বেঞ্চের নিচে দ্রুত মাথা-শরীর ঢোকানো, সিঁড়ির চাপ সামাল, মাঠে সমাবেশ সবকিছুই বাস্তবের মতো করে করা হয়। এ কারণে ২০১১ সালের ভয়াবহ তোহোকু ভূমিকম্প ও সুনামির সময় অনেক স্কুলে শিক্ষার্থীরা শৃঙ্খলা বজায় রেখে সময়মতো নিরাপদ স্থানে যেতে পেরেছিল যা হাজারো প্রাণ বাঁচিয়েছে।
জাপান নানাভাবে গোটা বিশ্বের সাথে আমাদেরকেও দেখিয়ে দিয়েছে প্রস্তুতিটি অভ্যাস না হলে তা কার্যকর হয় না। বাংলাদেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি সার্কুলার জারি করে বছরে দুইবার মহড়া বাধ্যতামূলক করতে পারে। ফায়ার সার্ভিস, সিভিল ডিফেন্স এবং স্থানীয় প্রশাসন মনিটরিং ও প্রশিক্ষণ সহায়তা দিতে পারে।
আমাদের দেশে প্রতিবছর বহুবার ভূমিকম্প হয়েছে। বহু সুপারিশ করা হয়েছে সেফটি ব্যবস্থা চালু করার জন্য কিন্তু আমরা কি আমাদের শিক্ষার্থীদের সেই ন্যূনতম প্রস্তুতিটুকুও দিয়েছি বা দিচ্ছি? অধিকাংশ স্কুলে জরুরি সিঁড়ি শুধু কাগজে আছে, অনেক ভবনে ফাটল বছরের পর বছর অচিহ্নিত, আর মহড়া তো দূরের কথা অনেক শিক্ষক জানেন না বিপদের সময় প্রথম কাজটি কী হওয়া উচিত। শিশুদের ওপর মানসিক চাপ ও বিশৃঙ্খলার প্রভাব এমনকি বড় ভূমিকম্প না হলেও আতঙ্কে আহত হওয়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
তাই বাংলাদেশের বাস্তবতায় বছরে দুইবার মহড়া চালু হলে কয়েকটি বড় পরিবর্তন ঘটবে যেগুলো, ভূমিকম্পের সময় আতঙ্কগ্রস্ত না হয়ে শিক্ষার্থীদের আচরণগত প্রস্তুতি তৈরি করবে। বিপদের সময় তারা স্বয়ংক্রিয়ভাবে সঠিক পদক্ষেপ নিতে পারবে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- ভূমিকম্প
- শিক্ষার্থী
- মহড়া