বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার দায় ও দিশা
দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের মুখোমুখি। উচ্চশিক্ষা কি পুরোনো রীতিতেই চলতে থাকবে, নাকি পরিবর্তিত সমাজ ও শ্রমবাজারের চাহিদা মেটাতে নিজেদের উদ্দেশ্য নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করবে?
বিশ্ববিদ্যালয়কে এখনো আমরা ভাবি তাত্ত্বিক চর্চার ক্ষেত্র হিসেবে, যা শ্রমবাজারের চাহিদা থেকে অনেকটাই দূরে। একদিকে সমাজ চায় সৃজনশীল, নৈতিক ও অভিযোজনে সক্ষম নাগরিক; অন্যদিকে শিল্প ও শ্রমবাজার চায় এমন স্নাতক, যে প্রথম দিন থেকেই নির্দিষ্ট কাজে দক্ষতা প্রদর্শন করতে পারে। এই দুই প্রত্যাশার মাঝখানে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন দিশাহীন।
দীর্ঘমেয়াদি শিক্ষার আদর্শ ও স্বল্পমেয়াদি কর্মদক্ষতা তৈরির চাপ—এই দুইয়ের মধ্যে সমন্বয়হীনতাই উচ্চশিক্ষার মূল উদ্দেশ্যকে ফেলেছে প্রশ্নের মুখে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব কেবল শিক্ষার্থীদের ডিগ্রি দেওয়া নয়, তাদের চিন্তা, দৃষ্টিভঙ্গি এবং মানবিক বোধের বিকাশ ঘটানো। সৃজনশীলতা, সহযোগিতা, পরিস্থিতির সঙ্গে মানানসই হওয়া ও আজীবন শিক্ষার ক্ষমতা কোনো কোর্সের সিলেবাসে আটকে রাখার মতো বিষয় নয়। এসব গড়ে ওঠে একটি গতিশীল, বুদ্ধিবৃত্তিক ও সামাজিক পরিবেশের মাধ্যমে।
নিয়োগকর্তাদের প্রত্যাশা থাকে, স্নাতকেরা যেন নির্দিষ্ট সফটওয়্যার চালনা থেকে শুরু করে প্রতিষ্ঠানের সব প্রক্রিয়ায় অবিলম্বে অবদান রাখতে পারে। এই বাস্তবতার চাপে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জরুরি ভিত্তিতে বিভিন্ন দক্ষতামূলক কোর্স চালু করছে। এসব উদ্যোগ প্রাসঙ্গিক, তবে প্রায়ই দেখা যায় এগুলো হয়ে উঠছে কোনোমতে কাজ চালানোর কেরামতি, যা শিক্ষার রূপান্তরমূলক ভূমিকাকে ক্ষুণ্ন করছে।
কর্মদক্ষতা নিয়ে একটি বড় ভ্রান্তি হলো, অনেকেই মনে করেন পাঠ্যক্রমে কয়েকটি ‘ট্রান্সফারেবল স্কিল’ যোগ করলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবতা এর চেয়ে জটিল। একজন শিক্ষার্থীর চাকরি পাওয়া ও কর্মক্ষেত্রে টিকে থাকা কেবল তার প্রযুক্তিগত দক্ষতার ওপরই নির্ভর করে না, করে তার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পুঁজির ওপরও।
একজন শহুরে সচ্ছল পরিবারের শিক্ষার্থী যেখানে সহজেই ইন্টার্নশিপ, মেন্টরশিপ ও নেটওয়ার্কিংয়ের সুযোগ পায়, তার সমান বা বেশি মেধাবী একজন প্রান্তিক শিক্ষার্থী সেদিক থেকে পিছিয়ে পড়ে। ফলে শুধু দক্ষতাভিত্তিক পাঠ্যক্রম চালু করলে তা অনেক ক্ষেত্রে বিদ্যমান সামাজিক বৈষম্যকে আরও গভীর করে তোলে। সুযোগের অসমতা আরও বাড়িয়ে দেয়।
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য প্রকৃত চ্যালেঞ্জ হলো রূপান্তর ও লেনদেন—এই দুইয়ের মধ্যে কোনো একটিকে বেছে নেওয়া নয়। অথচ তৈরি করা যেতে পারে এমন এক মডেল, যা অর্থপূর্ণভাবে দুই উদ্দেশ্যকেই এক সূত্রে গেঁথে দিতে পারে।
এটি অর্জনের জন্য কয়েকটি মৌলিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। শিক্ষাকে কেবল তত্ত্বের পাঠ থেকে বের করে এনে বাস্তব সমস্যা সমাধানের মুখোমুখি করতে হবে। এ জন্য সমস্যাভিত্তিক শিক্ষা, আন্তবিভাগীয় প্রকল্প, স্নাতক পর্যায়ের গবেষণা এবং কমিউনিটি এনগেজমেন্টের মতো পদ্ধতিগুলোকে পাঠ্যক্রমের কেন্দ্রে রাখা প্রয়োজন। এই পদ্ধতিগুলো শিক্ষার্থীদের অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে চিন্তাভাবনা করার ক্ষমতা এবং কার্যকর সমাধান খুঁজে বের করার দক্ষতা বিকাশে সহায়তা করে।