নিউ ইয়র্কের মেয়র মামদানি কতটুকু মুসলমান?
প্রাসঙ্গিক বিধায় একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা দিয়ে লেখাটা শুরু করতে চাই।
আমাদের বর্তমান নিবাস কানাডার এডমন্টন শহরে আমরা এসেছি প্রায় ১৮ বছর আগে। অন্য দশজন মুসলমানের মতো আমিও হালাল মাংসের দোকান খুঁজে পাবার চেষ্টা করি সে সময় নতুন আসা এ শহরে। অবশেষে একটা দোকান পেয়েও যাই। সেখান থেকে হালাল মাংস কিনি নিয়মিত। এভাবেই চলছিল বেশ। বছরখানেক পর এক ধার্মিক বাংলাদেশি ভাইয়ের সঙ্গে পরিচয় হলে আমার সেই হালাল মাংসের দোকানের কথা শুনে তিনি আস্তাগফিরুল্লাহ বলে দাঁতের ফালিতে জিহ্বা কেটে বললেন, 'গনি ভাই, আপনি তো ভুল করছেন; জানেন না, ওই দোকানের মালিক আসলে মুসলমান না!'
— না তো, আমি তো শুনেছি ওরা মুসলমান, অবাক হয়ে আমি জবাব দিলাম।
— আরে ভাই, নামে মুসলমান, আসল মুসলমান না, ওরা আসলে শিয়া।
— শিয়ারা মুসলমান না?
— কি যে বলেন, ইসলামের এই বেসিক জিনিসটাও আপনি জানেন না?
— তাহলে এখন কি করি?
— সমস্যা নেই, আপনাকে বাংলাদেশী সুন্নি মুসলমানের এক দোকানের ঠিকানা দিচ্ছি। ওদের কাছে আসল হালাল মাংস পাবেন।
হালালেও আবার আসল-নকল? কিঞ্চিৎ অবাকই হলাম।
নিজেকে নিজে প্রশ্ন করি, এই মুমিন মুসলমান স্বদেশীর সঙ্গে দেখা হতে আমার এতদিন লাগল কেন? 'ভেজাল হালাল' খেয়ে ইতোমধ্যেই অনেক গুনাহ হয়ে গেছে নিশ্চয়ই।
যাক, কয়েকদিন পর সেই দোকানে গিয়ে কয়েক পাউন্ড 'আসল হালাল' খাসির মাংস কিনে আনি।
খুব ছোটবেলা থেকেই আমাদের বড় ছেলে সাঈদের ঘ্রাণেন্দ্রিয় অতিপ্রখর। গন্ধ শুঁকে সে তার মাকে বললো, 'মা, আব্বু যে খাসির মাংস এনেছে তার গন্ধটা একটু অন্যরকম।'
অতঃপর আমার স্ত্রী, হালিমা আফরিন, নিজেও নাকের কাছে নিয়ে নিশ্চিত করল এটা আসলে খাসি নয়, ভেড়ার মাংস। কেবল তাই নয়, হাড়ের ভিড়ে সেখানে মাংস খুঁজে পাওয়াও দুষ্কর ছিল। বলা চলে, আশিভাগই হাড্ডি।
স্ত্রীকে দেশি ভাইয়ের পরামর্শের কাহিনি খুলে বলার পর সব শুনে সে আমাকে আবার আগের দোকান থেকেই মাংস কেনার পরামর্শ দিল। সেই থেকে আজও ওই দোকানের সঙ্গেই আছি, যদিও তারা সেই দেশি ভাইয়ের ভাষায় 'প্রকৃত মুসলমান' নন।
ব্যক্তিগত জীবনাচারের পাশাপাশি ব্যবসা-বাণিজ্যেও সততা বজায় রাখা মুসলমানদের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। সে আমলে আরবের অশিক্ষিত ও বর্বর জনগোষ্ঠীর মাঝে হজরত মুহম্মদ (স.) ইসলাম ধর্ম প্রচার করতে সক্ষম হয়েছিলেন তাঁর প্রশ্নাতীত সততা ও সত্যবাদিতার কারণেই। এ বিশেষ গুণের জন্য মুহম্মদ (স.)-কে তাঁর চরম শত্রুরাও বিশ্বাস করতেন, এবং প্রয়োজনে, তাঁর কাছে ধনদৌলত ও মূল্যবান সামগ্রী গচ্ছিত রাখতেন। এটাই ইসলামের শিক্ষা।
উল্লেখ্য, শিয়া এবং সুন্নি উভয় সম্প্রদায়ই ইসলামের মৌলিক নীতি, যেমন, তাওহিদ (একত্ববাদ), নবুয়াত এবং পুনরুত্থানে বিশ্বাস করে। অর্থাৎ, সুন্নিদের সঙ্গে শিয়াদের কিছু ধর্মীয় ব্যাখ্যা বা আইনগত মতপার্থক্য থাকলেও তারা ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলোতে অভিন্ন মত পোষণ করে। উপরের উদাহরণের সুন্নি ব্যবসায়ীর কাছে সততার পরিচয় আমি পাইনি, যা পেয়েছিলাম ওই শিয়া ব্যবসায়ীর কাছে। ইসলামের শিক্ষা বা নির্দেশনা বিবেচনায় এবার বোদ্ধা পাঠকই বিচার করুন তুলনামূলকভাবে এদের কে বেশি মুসলমান?
দুই.
বাঙালির মন ঐতিহাসিকভাবেই বড়ো কৌতূহলী। তারা নিজেরা কতখানি ধার্মিক, বা যথাযথভাবে নিজ ধর্ম পালন করে কিনা তার খোঁজ না রাখলেও সুদূর আমেরিকায় বসবাসরত জোহরান মামদানি, যিনি নিউ ইয়র্ক সিটির নবনির্বাচিত মেয়র, একজন সাচ্চা মুসলমান কিনা তা তাদের জানা একান্ত জরুরি। বেশ কিছুদিন ধরে সোশ্যাল মিডিয়ায় এ নিয়ে বিস্তর আলোচনা-সমালোচনা চলেছে। এখনো তা থেমে যায়নি। একপক্ষের দাবি তিনি প্রকৃতই একজন মুসলমান, অপরপক্ষ তাঁকে মুসলমান মানতে নারাজ। এ বিষয়টি নির্মোহভাবে পর্যালোচনা করার প্রয়াস থাকছে এ লেখায়।
মামদানির ধর্মবিশ্বাস নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণের মূলে ধর্মীয় ভাবনার পাশাপাশি রয়েছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও। অমুসলিম প্রমাণে সমালোচকদের কেউ বলছেন মামদানি শিয়া এবং তাদের ভাষায়, শিয়ারা মুসলমান নয়; কেউ বলছে তাঁর জন্মদাত্রী মা একজন অমুসলিম, তিনি মুসলমান হন কিভাবে?; তাঁর স্ত্রী খ্রিস্টানের মতো চলাফেরা করেন বলেও কেউ কেউ মন্তব্য করছেন; এছাড়া, মামদানি খাবার গ্রহণে হালাল-হারাম বাছবিচার করেন না, বা তিনি ইসলামে নিষিদ্ধ মদও পান করেন বলে অনেকে অভিযোগ তুলছেন। এভাবে নানামুখী অভিযোগে শিয়া সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত জোহরান মামদানির মুসলমানিত্ব খারিজ করে দিতে চাইছেন অনেকেই।
যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে জনবহুল শহর নিউ ইয়র্কের মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন দরিদ্র, ছিন্নমূল ও নির্যাতিতের পক্ষে নিরলসভাবে কাজ করা তরুণ জোহরান মামদানি। তিনি নিউ ইয়র্ক সিটির ১১১তম মেয়র, এবং বিগত ১০০ বছরের মধ্যে কনিষ্ঠতম মেয়র; যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথম মুসলিম মেয়র তো বটেই। তাঁকে হারাতে যুক্তরাষ্ট্রের অনেক বিলিয়নেয়ার একযোগে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার খরচ করেছিলেন খ্রিস্টান-ইহুদি ভোটারদের তার বিরুদ্ধে কাজে লাগাতে। ফল হিতে বিপীত হয়েছে। বিগত ৫০ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি, বিশ লাখেরও অধিক, ভোটদাতা এবারের নিউ ইয়র্ক সিটির মেয়র নির্বাচনে ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। কিন্তু, তারপরও তারা মামদানির বিজয় ঠেকাতে পারেননি। কার্যত ইহুদিদের অনেকেই মামদানিকে ভোট দিয়েছেন। খ্রিস্টানদের ভোট তো পেয়েছেনই।
খ্যাতনামা ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা আমেরিকা প্রবাসী মীরা নায়ার তার মা, আর, উগান্ডা হতে আমেরিকায় আসা বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও লেখক মাহমুদ মামদানি তার বাবা। মাহমুদ মামদানির জন্ম ভারতের গুজরাটে। অর্থাৎ, তিনি একজন গুজরাটি মুসলমান। রামা দুয়াজি মামদানির স্ত্রী। তিনি সিরিয়ান বংশোদ্ভূত আমেরিকান মুসলমান। একজন চিত্রশিল্পী। তাঁর পিতামাতাও জোহরান মামদানির পিতামাতার মতো উচ্চশিক্ষিত আধুনিক মনের মানুষ।
ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী, নরেন্দ্র মোদী, গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে গুজরাটে মুসলমানদের ওপর যে মানবাধিকার লঙ্ঘন, সহিংসতা ও নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছিল তাতে তার ভূমিকা নিয়ে কঠোর সমালোচনা করেছেন জোহরান মামদানি। ২০২০ সালে অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে দিয়ে সেখানে হিন্দু মন্দির স্থাপনের প্রকাশ্য বিরোধিতা করতে আমেরিকার টাইমস স্কয়ারে অনুষ্ঠিত বিক্ষোভেও অংশ নিয়েছিলেন জোহরান। সে সময়ের এক সাক্ষাৎকারে তিনি মোদীকে যুদ্ধাপরাধী বলেও আখ্যায়িত করেছিলেন। প্রতিবাদের ঝড়ে মোদীর ভিসাও বাতিল করেছিল যুক্তরাষ্ট্র।
- ট্যাগ:
- মতামত
- সিটি মেয়র নির্বাচন