আড়ি পাতা বা নজরদারির বিষয়ে উন্নত দেশে যা করা হয়
আমাদের হাতে থাকা মোবাইল ফোন এখন আর কেবল যোগাযোগের যন্ত্র নয় বরং এটি ব্যক্তিগত জীবনের এক ডিজিটাল রেকর্ড। প্রতিটি কল, বার্তা, লোকেশন, এমনকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কাটানো সময়ও একেকটি তথ্যচিহ্ন। এই তথ্য রাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যেমন অপরিহার্য, তেমনি নাগরিকের গোপনীয়তার জন্য তা অত্যন্ত সংবেদনশীল।
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে নাগরিকের ফোন ও অনলাইন তথ্য নিয়ন্ত্রণ নিয়ে উদ্বেগ বেড়েছে। সরকার সাইবার অপরাধ প্রতিরোধ, সন্ত্রাস দমন বা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে মোবাইল ফোনের তথ্য সংগ্রহ করতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হলো “এই নিয়ন্ত্রণ কতদূর পর্যন্ত বৈধ ও ন্যায়সঙ্গত? এবং কীভাবে তা নাগরিকের গোপনীয়তা ক্ষুণ্ণ না করেই পরিচালিত হতে পারে?”
নিয়ন্ত্রণের আইনি কাঠামো
বাংলাদেশ সরকার মোবাইল ফোনের তথ্য নিয়ন্ত্রণ করে মূলত দুটি আইনের আওতায়—
(ক) বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০০১: এই আইনের আওতায় বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (BTRC) মোবাইল অপারেটরদের লাইসেন্স প্রদান ও পরিচালনা তদারক করে। আইনটির ধারা ৯৭ অনুযায়ী, “রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বা জনস্বার্থে” সরকার যেকোনো টেলিযোগাযোগ কার্যক্রমে প্রবেশাধিকার বা নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে।
এই বিধান সরকারকে “ল’ফুল ইন্টারসেপ্ট” বা আইনসম্মতভাবে ফোনকল ও ডেটা নজরদারির ক্ষমতা দেয়। এই আইনের বলা আছে “রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বা জনস্বার্থে সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারে”। এর মানে, আদালত বা অনুমোদিত কর্তৃপক্ষের নির্দেশে ফোনকল, মেসেজ বা লোকেশন ট্র্যাক করার ক্ষমতা সরকারের আছে।
(খ) ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ (বর্তমানে সাইবার নিরাপত্তা আইন, ২০২৩): এই আইনের মাধ্যমে সরকার অনলাইন অপরাধ, ভুয়া তথ্য, সাইবার সন্ত্রাস বা রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে। ফলে কোনো সন্দেহজনক কার্যকলাপের ক্ষেত্রে, সরকার বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী “ডিজিটাল অপরাধ প্রতিরোধে” মোবাইল ও অনলাইন তথ্য সংগ্রহ করতে পারে। যদিও আইনটির উদ্দেশ্য ছিল সাইবার নিরাপত্তা/জননিরাপত্তা নিশ্চিত করা, বাস্তবে এর প্রয়োগে নাগরিক স্বাধীনতা ও সংবাদমাধ্যমের গোপনীয়তা নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে।
মোবাইল ফোন তথ্যের ধরন ও নিয়ন্ত্রণের প্রকৃতি
একটি মোবাইল অপারেটরের কাছে যে ধরনের তথ্য থাকে তা মূলত তিন শ্রেণিতে ভাগ করা যায়।
প্রথমত, ব্যক্তিগত শনাক্তকরণ তথ্য (Personal Identifiers), যেখানে নাম, জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর, ঠিকানা, বায়োমেট্রিক ডেটা ইত্যাদি তথ্য থাকে।
দ্বিতীয়ত, মেটাডেটা (Metadata), যেখানে কে কাকে কল করেছে, কতক্ষণ কথা হয়েছে, কোন টাওয়ার থেকে সংযোগ স্থাপন করা হয়েছে ইত্যাদি তথ্য থাকে।
তৃতীয়ত, কনটেন্ট ডেটা (Content Data), যেখানে কলের অডিও, এসএমএস বা অনলাইন বার্তার আসল বিষয়বস্তুর তথ্য থাকে।
বাংলাদেশে ২০১৬ সাল থেকে সিম নিবন্ধনের সময় নাগরিকের বায়োমেট্রিক তথ্য (আঙুলের ছাপ) ব্যবহার বাধ্যতামূলক হওয়ায় অপারেটরদের হাতে ব্যক্তিগত তথ্যের ঘনত্ব অনেক বেড়েছে। এর ফলে তথ্য নিরাপত্তা ও নাগরিক গোপনীয়তার ভারসাম্য আরও জরুরি হয়ে উঠেছে। সরকার সাধারণত “ল’ফুল ইন্টারসেপ্ট” প্রক্রিয়ায় মেটাডেটা ব্যবহার করে তদন্ত চালায়। কিন্তু কনটেন্ট ডেটা বা ব্যক্তিগত কথোপকথন কেবল আদালতের অনুমতি ছাড়া দেখা বা শোনা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী গোপনীয়তার লঙ্ঘন।
গোপনীয়তা ও নজরদারি: ভারসাম্যের চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশের সংবিধানের ৪৩ নম্বর অনুচ্ছেদ নাগরিককে “ব্যক্তিগত যোগাযোগের গোপনীয়তা ও গৃহের স্বাধীনতা” নিশ্চিত করেছে। অর্থাৎ, ফোনালাপ বা বার্তা তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ থেকে সুরক্ষিত থাকবে তবে যদি না আদালত বা আইনসম্মত প্রক্রিয়ায় অন্যথা নির্দেশ দেয়। কিন্তু বাস্তবে রাষ্ট্রীয় নজরদারি প্রায়ই এই সীমারেখা অতিক্রম করে।
অনেক ক্ষেত্রে অনুমতি ছাড়াই তথ্য সংগ্রহের অভিযোগ ওঠে। ফলে নিরাপত্তার নামে গোপনীয়তা ক্ষুণ্ণ হয় এবং নাগরিক স্বাধীনতার পরিধি সংকুচিত হয়। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন ২০১৩ (UNHRC, ২০১৩) সালে বলেছিল, “নজরদারি তখনই বৈধ, যখন তা প্রয়োজনীয়, অনুপাতমূলক এবং বিচারিক অনুমোদিত”। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই মানদণ্ড পূরণ এখনো চ্যালেঞ্জের মুখে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- নজরদারি
- আড়িপাতা
- ব্যক্তিগত গোপনীয়তা