কে কতটা বা কেমন মুসলমান, তা কোনো ব্যাপার নয়, জন্মসূত্রে মুসলমান হলেই হলো। কোনো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ থেকে আগত অভিবাসী নামে মুসলমান হলেই হলো। তারা ‘হোয়াইট সুপ্রিমেসি’ বা শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্বের ধারক-বাহকদের চক্ষুশূল এবং আপত্তির পাত্র। নিউইয়র্ক সিটির সদ্য নির্বাচিত মেয়র জোহরান মামদানিও এমন এক অবস্থার মধ্যে পড়েছেন। বিপুল জনসমর্থনে ধন্য এবং বেশ জমজমাট নির্বাচনে বিজয়ী হলেও তাকে সাদরে বরণ করতে পারছে না ‘হোয়াইট সুপারম্যাসিস্টরা’, যারা বিশ্বাস করে তারা বিশেষ ধরনের মানুষ, যারা অন্য ধরনের মানুষের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা ও তাদের নেতৃত্ব দেওয়ার যোগ্য। কারণ তারাই সবার সেরা। তা না হলে গত জুনে ডেমোক্রেটিক প্রাইমারিতে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় বিজয় লাভের পর জোহরান মামদানিকে চূড়ান্ত নির্বাচনে বিজয় নিশ্চিত করার জন্য এতটা প্রবলভাবে প্রচারাভিযান চালাতে হতো না। সন্দেহ নেই তিনি জনপ্রিয় ছিলেন, কিন্তু তার জনপ্রিয়তায় ধস নামানোর জন্য প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার নিজস্ব দল রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী কার্টিস স্লিওয়াকে ভোট না দিয়ে ডেমোক্রেটিক প্রাইমারিতে মামদানির কাছে লজ্জাজনকভাবে পরাজিত প্রার্থী নিউইয়র্ক স্টেটের সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু ক্যুমোকে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানান, যা সাধারণ ভোটাররা ভালোভাবে গ্রহণ করেননি। ট্রাম্পের ‘মামদানি ঠেকাও’ নীতি অনুসরণে রিপাবলিকানদের একটি অংশ সব জরিপে বিপুল ব্যবধানে দ্বিতীয় স্থানে থাকা কু্যুমোকে সমর্থন দিয়েছেন।
জোহরান মামদানি কতটা মুসলিম, তা এখন আর বিচার্য নয়। তিনি নিউইয়র্কের ইতিহাসের অংশ। তিনি বিশাল সিটির প্রথম মুসলিম মেয়র নির্বাচিত হয়ে নিউইয়র্ক সিটির চারশ বছরের ইতিহাস ভেঙেছেন, যা চাইলেই মুছে ফেলা যাবে না। শুধু তাই নয়, তিনি দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত প্রথম মেয়র। তাছাড়া গত একশ বছরের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে কনিষ্ঠ মেয়র। যে ইস্যুগুলো নিয়ে আগে কেউ এত জোরালোভাবে কথা বলেননি, বা প্রতিশ্রুতি দেননি; যেমন, শ্রমজীবী মানুষের জন্য সাশ্রয়ী মূল্যে আবাসন, বিনামূল্যে শিশু পরিচর্যা, সিটিতে চলাচলের জন্য বিনামূল্যে বাস সার্ভিস চালু, ন্যূনতম মজুরি বর্তমান হার থেকে বাড়িয়ে ঘণ্টাপ্রতি ৩০ ডলার নির্ধারণ। তার নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি থেকে মনে হতে পারে, নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার জন্য ভোটারদের আকৃষ্ট করতে এসব মুখরোচক সস্তা স্লোগান। কিন্তু আমেরিকান প্রেক্ষাপটে তা হওয়ার উপায় নেই। তাকে তার প্রতিশ্রুতি পালন করতে হবে। কীভাবে তিনি তার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে বিপুল অর্থের সংস্থান করবেন, সে বিষয়েও রূপরেখা দিয়েছেন। সবকিছু বিশ্লেষণ করে উপসংহারে উপনীত হওয়া যেতে পারে যে, নিউইয়র্ক সিটির প্রথম মুসলিম ও প্রথম দক্ষিণ এশীয় মেয়র হিসাবে তিনি ইতিহাস গড়তে যাচ্ছেন।
জোহরান মামদানির বিজয়ের পর তার প্রচারণাকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়া বারাক ওবামার ঐতিহাসিক নির্বাচনি প্রচারণার সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে। কেবল একটি দিক ছাড়া মেয়র পদে মামদানির নির্বাচন ওবামার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার সঙ্গে অবশ্যই তুলনীয়। তা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে প্রার্থী হওয়ার জন্য জন্মসূত্রে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হওয়া আবশ্যক, যা বারাক ওবামা ছিলেন; কিন্তু সিটি মেয়র, কংগ্রেসম্যান, স্টেট অ্যাসেম্বলিম্যানসহ অন্যান্য পদে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে জন্মসূত্রে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হওয়ার আবশ্যকতা নেই। জোহরান মামদানি ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাচারালাইজড নাগরিক হয়েছেন।
যে কোনো নির্বাচনে নানা গোষ্ঠীর নানা স্বার্থ জড়িত থাকে। মামদানির বিপক্ষে যে কেবল নিউইয়র্কের বিলিয়নিয়ার শ্বেতাঙ্গ ব্যবসায়ীগোষ্ঠী এবং প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পসহ রিপাবলিকানরাই তাদের কণ্ঠ সোচ্চার করেছিল তা নয়, বাংলাদেশি কমিউনিটিসহ বিভিন্ন অভিবাসী কমিউনিটির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ, বিশেষ করে যারা বাড়ির মালিক ও বাড়ি বা অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া দেন, তারা ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিস্ট মামদানির বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার জন্য জোটবদ্ধ হয়েছিলেন। মামদানি অ্যাফোর্ডেবল হাউজিং বা সাশ্রয়ী মূল্যে আবাসনের ব্যবস্থা করার নীতির পক্ষে নির্বাচনি প্রতিশ্রুতিতে বাড়ির মালিকদের দ্বারা স্বেচ্ছাচারমূলক বাড়িভাড়া বৃদ্ধি রোধ করে ‘রেন্ট স্ট্যাবিলাইজড’ বা ভাড়া স্থিতিশীল রাখার কথা বলেছেন। বাড়ির মালিকরা মামদানির এ উদ্যোগের প্রকাশ্য বিরোধিতা করেছে এবং তার বিরুদ্ধে ভোট প্রদান করেছে। অবশ্য এর ফলে মামদানির বিজয়ে বাধা সৃষ্টির মতো কোনো প্রভাব পড়েনি। কারণ, নিউইয়র্ক সিটিতে বাড়ির মালিকের সংখ্যা এত বেশি নয় যে তাদের পক্ষে কোনো প্রার্থীর জয়-পরাজয়ে ভূমিকা রাখা সম্ভব। নিউইয়র্কে বাংলাদেশিদের একটি অংশ, যারা মূলত আওয়ামী লীগ ও বাম ঘরানার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট, তারাও মামদানির বিরুদ্ধাচরণ করেছে। কারণ বহু শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানের মতো তারা মনে করেন, মামদানি একজন মুসলমান। বিশেষ করে নিউইয়র্কে জামায়াত অনুসারী ও ইসলামি ধারায় বিশ্বাসী বাংলাদেশিরা মামদানির প্রতি সহানুভূতিশীল থাকায় আওয়ামী ঘরানার বাংলাদেশি আমেরিকানরা মামদানিকে আস্থায় নিতে পারেনি। তারা বরং এমন অপপ্রচার করতে পিছু হটেনি যে, মামদানি নিউইয়র্কের মেয়র নির্বাচিত হলে নিউইয়র্ক সিটি ইসলামপন্থিদের হাতে চলে যাবে। নিউইয়র্ক স্টেট বাংলাদেশের মতো আধা-আফগানিস্তান হয়ে যাবে। এটা নিশ্চিতভাবেই তাদের হীন মানসিকতার পরিচায়ক এবং রাজনীতি বর্জিত চিন্তাচেতনার ফল ছিল, যা মামদানি জোয়ারে ভেসে গেছে। কারণ মামদানি নিউইয়র্ক সিটিতে বসবাসকারী ৯ শতাংশের কমসংখ্যক মুসলমানের ততধিক কমসংখ্যক ভোটদানে অনভ্যস্ত ভোটারের ওপর নির্ভর করে মেয়র পদে প্রার্থী হননি। মুসলিম নিউইয়র্কবাসীদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ তার পক্ষে নির্বাচনি প্রচারণায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে একথা সত্য, কিন্তু তারাই মামদানির বিজয়ের সূচক ছিলেন না।
নিউইয়র্ক সিটির মেয়র পদে মামদানির বিস্ময়কর বিজয়ের পেছনে বেশকিছু কারণ রয়েছে, যার অন্যতম ছিল, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আহ্বানে স্বতন্ত্র প্রার্থী অ্যান্ড্রু ক্যুমোর পক্ষে রিপাবলিকান ভোট পড়লে মামদানির বিজয়ের পথে বিঘ্ন হতে পারে আশঙ্কায় সিটির শ্রমজীবী মানুষের একটি জোট ভোটারদের নির্বাচন কেন্দ্রমুখী হতে অনুপ্রাণিত করেছিল। এ জোট ছিল প্রধানত সিটির কুইন্স ও ব্রঙ্কস বরোতে বসবাসকারী শ্রমজীবী দক্ষিণ এশিয়ান অভিবাসী কমিউনিটি। চৌত্রিশ বছর বয়সের মামদানি ৪ নভেম্বর নিউইয়র্কের ১১১তম মেয়র নির্বাচিত হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে জনবহুল ও গুরুত্বপূর্ণ সিটিতে ঐতিহাসিক আদর্শিক পরিবর্তন সাধনের সূচনা করেছেন, যা সম্ভব হয়েছে তার প্রতি বর্তমান প্রজন্মের আস্থার কারণে। আমেরিকান বার্তা সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি) ভোটগ্রহণ বন্ধ হওয়ার ঠিক ৩৫ মিনিট পর এ নির্বাচনকে বিস্ময়কর অভিহিত করেছে, যা জোরদার হতে শুরু করেছিল গত জুনে অনুষ্ঠিত ডেমোক্রেটিক প্রাইমারিতে। তাদের মতে, ‘তখন (জুন ২০২৫) এবং এখন (৪ নভেম্বর ২০২৫) মামদানি একটি ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক পরিবারকে বিপর্যস্ত করেছেন, যার বর্তমান প্রতিনিধি নিউইয়র্ক স্টেটের সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু এম ক্যুমো। নিউইয়র্কের ধনবানরা প্রায় সবাই মামদানির মেয়র হওয়ার সম্ভাবনাকে পালটে দিতে ক্যুমোর প্রতি তাদের সার্বিক সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল।
সিটি মেয়র নির্বাচনের ফলাফল থেকে বোঝা যায়, মামদানি কতটা সূক্ষ্মভাবে তার নিজস্ব সমর্থনের নতুন জোট গড়ে তুলেছিলেন। তিনি কুইন্সের নবীন ভোটারদের শ্রমজীবী মানুষ ও অভিবাসীদের বসবাস যেখানে বেশি, সেখানে তাদের একত্রিত করেছেন। গত জুনে ডেমোক্রেটিক প্রাইমারির তুলনায় তিনি গত মঙ্গলবারের চূড়ান্ত নির্বাচনে শ্রমজীবী কৃষ্ণাঙ্গ এবং ল্যাটিনো কমিউনিটি থেকেও ভালো ভোট পেয়েছেন। এ কারণে দেখা যায়, ১৯৬০ সালের পর সিটির মেয়র নির্বাচনে মামদানি সর্বাধিক ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রে যে কোনো নির্বাচনে ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার হার সর্বনিম্ন। সেক্ষেত্রে মেয়র নির্বাচনে নিউইয়র্ক সিটিতে ভোটকেন্দ্রগুলোতে ভোট দেওয়ার জন্য ভোটারদের ঢল নেমেছিল বলা যেতে পারে। এমন দৃশ্য গত অর্ধশতাব্দীতে দেখা যায়নি। বিশ লাখের বেশি নিউইয়র্কবাসী তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। চার বছর আগে মেয়র পদে ভোট দিয়েছিল ১১ লাখ ভোটার। এবার সে সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ। নিজেকে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রী হিসাবে ঘোষণাকারী জোহরান মামদানির প্রতিশ্রুতি তাকে ভোটারদের কাছে জনপ্রিয় করে তুলেছিল। ১৯৬৯ সালের মেয়র পদপ্রার্থী জন ভি. লিন্ডসের পর তিনিই প্রথম প্রার্থী যিনি সিটির পাঁচ বরোতে মেয়র পদে দশ লাখের বেশি ভোটে জয়ী হয়েছেন। অবশ্য ১৯৬৯ সালে নিউইয়র্ক সিটির মেয়র নির্বাচনে ভোট দিয়েছিল ২,৪৫৮,২০৩ জন ভোটার।