জোহরান মামদানির জয়, বাস্তবতা নাকি ক্যারিশমা?
নিউইয়র্ক সিটির নতুন ইতিহাস রচিত হলো ২০২৫ সালের নির্বাচনে। মাত্র ৩৪ বছর বয়সে জোহরান মামদানি যখন যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম শহরের মেয়র নির্বাচিত হলেন, তখন তা শুধু প্রজন্মগত পরিবর্তনের প্রতীক নয়, বরং আদর্শিক পুনর্জাগরণের এক ঘোষণাও।
আফ্রিকায় জন্ম নেওয়া, ভারতীয় বংশোদ্ভূত এই তরুণ অভিবাসী রাজনীতিক এমন এক সময়ে দায়িত্ব গ্রহণ করলেন, যখন আমেরিকান রাজনীতি আবার নতুন করে সংজ্ঞায়িত হচ্ছে প্রগতিশীলতা বনাম স্থবির ঐতিহ্যবাদের সংঘর্ষে। এমন এক নির্বাচনে, যেখানে সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু মার্ক কুওমো নিউইয়র্ক রাজনীতির এক প্রভাবশালী নাম এবং রিপাবলিকান প্রার্থী কার্টিস স্লিওয়ার মতো শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন, সেখানে মামদানির জয় ছিল বিস্ময়কর।
ভোট গ্রহণ শেষ হওয়ার মাত্র ৩৫ মিনিটের মধ্যেই অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস তার জয় ঘোষণা করে। নিউইয়র্কবাসী শুধু একজন নতুন মুখকে বেছে নেননি; তারা এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, এক নতুন রাজনীতির ভাষা গ্রহণ করেছেন।
জোহরান মামদানির বিজয়কে ‘জেনারেশনাল আপরাইজিং’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এক শতাব্দীর মধ্যে সবচেয়ে কনিষ্ঠ মেয়র হিসেবে তার অভিষেক ইঙ্গিত দিচ্ছে নিউইয়র্কবাসী এখন এমন নেতৃত্ব চায়, যা তাদের বাস্তব জীবন ও ভবিষ্যতের সাথে সংযুক্ত।
এই প্রজন্ম জলবায়ু পরিবর্তন, সামাজিক বৈষম্য, আবাসন সংকট, পুলিশ সংস্কার এবং অভিবাসী অধিকার এসব ইস্যুকে কেবল রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি নয়, জীবনের প্রাত্যহিক বাস্তবতা হিসেবে দেখে। মামদানি ঠিক সেই প্রজন্মের প্রতিনিধি, যিনি বারবার বলেছেন, ‘নিউইয়র্ক শুধু ধনীদের শহর নয়, এটি শ্রমিকদের, শিক্ষার্থীদের, অভিবাসীদের এবং স্বপ্নদর্শীদের শহর।’
তার প্রচারণা তরুণ ভোটারদের মধ্যে বিরাট সাড়া ফেলেছিল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনি ছিলেন সরাসরি, সৎ ও ব্যতিক্রমী রাজনৈতিক ভাষার জটিল অলংকারের পরিবর্তে ব্যবহার করেছেন মানবিক গল্প। অনেক তরুণ কর্মী বলেছেন, মামদানির প্রচারাভিযান ছিল ‘রাজনীতি নয়, আন্দোলন’ যেখানে মানুষ নিজেদের ভবিষ্যতের অংশীদার হিসেবে দেখেছে।
মামদানির প্রচারণার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল ‘ইকোনমিক জাস্টিস ফর অল’ অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের প্রতিশ্রুতি। নিউইয়র্কের ক্রমবর্ধমান আয়-বৈষম্য, গৃহহীনতার সংকট এবং জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির মধ্যে তিনি প্রস্তাব করেছেন এমন এক শহরব্যাপী পরিকল্পনা, যেখানে উন্নয়ন মানে কেবল আকাশচুম্বী ভবন নয়, বরং মানুষের মর্যাদাপূর্ণ জীবন।
তিনি বলেছেন, ‘যদি নিউইয়র্ক বিশ্বের রাজধানী হয়, তবে এখানে কোনো নাগরিকের ঘুমানোর জায়গা না থাকা সভ্যতার ব্যর্থতা।’ তার বাজেট প্রস্তাবে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে সাশ্রয়ী মূল্যের আবাসন প্রকল্প, শ্রমিক অধিকার সুরক্ষা, ও গণপরিবহন ব্যবস্থার সংস্কার। ‘রেন্ট জাস্টিস’ ভাড়ার ন্যায্যতা মামদানির অন্যতম মূল ইস্যু ছিল, যা নিম্ন আয়ের নিউইয়র্কবাসীদের মধ্যে গভীর সাড়া তোলে। এই ইস্যুগুলোর মাধ্যমে মামদানি নিজেকে এমন এক রাজনীতিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন, যিনি অর্থনৈতিক শক্তির বিপরীতে সামাজিক ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াতে সাহস করেন।
জোহরান মামদানির জয় বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়; এটি যুক্তরাষ্ট্রে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রগতিশীল পুনরুত্থানেরই অংশ। এবারের নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটরা একাধিক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গরাজ্যে সাফল্য দেখিয়েছে। দ্য গার্ডিয়ান এর বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, মামদানির ঐতিহাসিক জয়ের দিনই ভার্জিনিয়ায় অ্যাবিগেইল স্প্যানবার্গার প্রথম নারী গভর্নর হিসেবে নির্বাচিত হন; নিউ জার্সিতে সাবেক নৌবাহিনী কর্মকর্তা মিকি শেরিল রিপাবলিকান ব্যবসায়ী জ্যাক সিয়াটারেলিকে পরাজিত করেন এবং ক্যালিফোর্নিয়ায় গভর্নর গ্যাভিন নিউজমের রিডিস্ট্রিকটিং প্রস্তাব (‘প্রপ ৫০’) পাস হয়েছে, যা ডেমোক্র্যাটদের জন্য কংগ্রেসে পাঁচটি নতুন আসন তৈরি করতে পারে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- সিটি মেয়র নির্বাচন