সমন্বিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা : সময়ের দাবি
একটি শহরের বাসযোগ্যতা অন্য অনেক বিষয়ের পাশাপাশি নির্ভর করে তার পরিবেশ ও প্রকৃতির ওপর। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইকিউএয়ারের বৈশ্বিক বায়ুমান প্রতিবেদন ২০২৪ অনুযায়ী, বায়ুদূষণে বাংলাদেশ দ্বিতীয় এবং শহর হিসাবে ঢাকার অবস্থান তৃতীয়। ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) ২০২৫ সালের গ্লোবাল লিভেবিলিটি ইনডেক্সে বাংলাদেশের এ রাজধানী শহর ১৭১তম অবস্থানে রয়েছে। গত কয়েক দশক ধরে এ ধারা অব্যাহত রয়েছে, যা প্রমাণ করে বাসযোগ্যতার পরিমাপের মাপকাঠিতে আমাদের অবস্থান একদম নিচের স্তরে। এর অনেক কারণের একটি হলো বর্জ্য। শুধু সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাবে আমরা প্রাণ ও প্রকৃতিকে ভয়াবহ বিপর্যয়ের টেনে নিয়ে যাচ্ছি, একইসঙ্গে বাসযোগ্য পরিবেশ ধ্বংস করে দিচ্ছি। উদাহরণস্বরূপ, ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-আরিচা, ঢাকা-গাজীপুর, ঢাকা-চট্রগ্রাম মহাসড়কের সংরক্ষিত বন এলাকায়, জলাভূমিতে যত্রতত্র স্তূপাকারে ফেলা হচ্ছে, বিভিন্ন সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার গৃহস্থালি বর্জ্য, শিল্পকারখানার বর্জ্য, মেডিকেল বর্জ্য ইত্যাদি। এসব ময়লার দুর্গন্ধে সড়কে গাড়িযোগে চলাচলকারীদেরই নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। ওই এলাকায় বসবাসকারী নাগরিকরা কী মাত্রায় মানবেতর জীবনযাপন করে এবং কেন আমরা বাসযোগ্যতায় পিছিয়ে আছি, তা সহজেই অনুমেয়।
প্রতিটি শহরাঞ্চলেই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও প্রক্রিয়াকরণের সমস্যা রয়েছে। গাজীপুর সাভার, নরসিংদী এলাকায় শিল্পকারখানা বেশি হওয়ায় জনঘনত্ব বেশি। তাছাড়া গাজীপুর, সাভার এলাকায় কোনো ডেজিগনেটেড কোনো বর্জ্য ডাম্পিং স্টেশন, স্যানিটারি ল্যান্ডফিল নেই। অবশ্য ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ফেলার জন্য আমিনবাজার ও মাতুয়াইল দুটি ল্যান্ডফিল রয়েছে। তবে ল্যান্ডফিলের ধারণ ক্ষমতা উৎপাদিত বর্জ্যরে তুলনায় কম এবং সঠিকভাবে প্রক্রিয়াকরণ না হওয়ায় এগুলোতে উপচে পড়ছে বর্জ্য। ফলে দিনে দিনে বর্জ্য সমস্যাকে প্রকট হচ্ছে এবং পানি মাটি বাতাস মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে, যার ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে মানুষ, অন্য প্রাণী ও প্রকৃতির ওপরে।
কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমালা ২০২১-এর ১০(২৫) নম্বর বিধিতে বলা আছে, ‘নতুন সিটি করপোরেশন অথবা পৌরসভা প্রতিষ্ঠা করার সময় নগর ব্যবহার পরিকল্পনায় কঠিন বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ, পরিশোধন এবং ল্যান্ডফিলের জন্য নির্দিষ্ট স্থান অন্তর্ভুক্তকরণ।’ অর্থাৎ পৌর এলাকায় আবশ্যিকভাবে একটি ল্যান্ডফিল থাকবে।
নগর এলাকার একটি মাঝারি মানের পৌরসভায় গড়ে প্রতিদিন কমবেশি ৫০ টন বর্জ্য উৎপন্ন হয়, শিল্প এলাকায় এর পরিমাণ আরও বেশি। কিন্তু বেশিরভাগ পৌরসভারই নিজস্ব ডাম্পিং স্টেশন নেই অর্থাৎ কোনো পৌর বর্জ্যই সঠিকভাবে প্রক্রিয়াকরণের সুযোগ নেই। এভাবে চলতে থাকলে দিনের পর দিন দূষিত পরিবেশে প্রাণ প্রকৃতি বিলুপ্ত হয়ে যাবে। তাহলে এর সম্ভাব্য সমাধান কী হতে পারে?
বাংলাদেশের শহরগুলোর জনঘনত্ব বিবেচনায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনার লক্ষে কোনো একটি পদ্ধতি যেমন : শুধু কমপোস্টিং অথবা ইনসিনারেশন (বর্জ্য পোড়ানোর) মাধ্যমে বর্জ্য সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। এ জন্য প্রয়োজন পরিকল্পিত এবং সমন্বিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি।
কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমালা, ২০২১-এ স্পষ্টভাবে সমন্বিত পদ্ধতির কথাই বলা আছে। বিশ্বের অন্যান্য উন্নত দেশ যেমন-জাপান, সিঙ্গাপুর, জার্মানির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এসব দেশের বর্জ্যরে কিছু অংশ পোড়ানো হয়, কিছু অংশ পুনর্ব্যবহার এবং বর্জ্যরে জৈব উপাদান থেকে জৈবসার তৈরি করা হয়। অনেক দেশের অর্থনীতিতেও বর্জ্য গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে, যা সার্কুলার ইকোনমি নামে পরিচিত।
সাভার, গাজীপুর এলাকাসহ শিল্প এলাকার বর্জ্যরে পরিমাণ বেশি হওয়ায় দ্রুত প্রক্রিয়াকরণের লক্ষ্যে এখানকার জন্য বর্জ্য পোড়ানো (ইনসিনারেশন) পদ্ধতি যথোপযুক্ত। যদিও এর কিছু ক্ষতিকর দিক রয়েছে। তবে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করলে এ ক্ষতি এড়ানো সম্ভব। একইসঙ্গে এটি একটি টেকসই ও পরিবেশবান্ধব বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি হতে পারে। ঢাকা ও এর আশপাশের ঘনবসতিপূর্ণ শহরের জন্য ইনসিনারেশন পদ্ধতি ব্যতিরেকে এ বিশাল আয়তনের ময়লা অপসারণ অসম্ভব।
- ট্যাগ:
- মতামত
- বর্জ্য ব্যবস্থাপনা