
প্রফেসর ইউনূস ভেবে দেখবেন কি
গত কিছুদিন ধরে কী সাংবাদিক, কী অধ্যাপক এবং কী বন্ধুবান্ধব, যাদের সঙ্গেই দেখা হয়েছে, তারা জানতে চেয়েছেন, ২০২৬-এর ফেব্রুয়ারিতে নির্ধারিত সাধারণ নির্বাচনটি হবে কিনা। তাদের এ উদ্বেগের কারণ আমি বুঝতে পারি। কারণ নির্বাচন নিয়ে সবচেয়ে বেশি মুখর ছিল বিএনপি। ২০২৪-এর ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার শপথ নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিন মাসের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানিয়েছিলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এত তাড়াহুড়া করে নির্বাচন দাবি করা সঠিক হয়েছিল কিনা, তা নিয়ে আমার চেনা-জানা অনেকেই প্রশ্ন তুলেছিলেন। তাদের কথা ছিল সরকারকে নিশ্বাস ফেলার সময় না দিয়ে নির্বাচন দাবি করা কতটা যৌক্তিক। এ বিষয়ের প্রতি বিএনপি মহাসচিব মির্জা আলমগীরের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি আমাকে জানান, আমরা একটি রাজনৈতিক দল, রাজনৈতিক দল হিসাবে আমরা তো নির্বাচন চাইবই। এরপর বিভিন্ন সময়ে নির্বাচনের রোডম্যাপ দাবি করলে সরকার কোনো স্পষ্ট জবাব দেয়নি। একপর্যায়ে প্রফেসর ইউনূস জানালেন নির্বাচনটি ২০২৬-এর জুনে অনুষ্ঠিত হতে পারে, নির্বাচন আগেও অনুষ্ঠিত হতে পারে যদি সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা যায়।
এ পর্যায়ে বিএনপি ২০২৫-এর ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবি জানাতে থাকে। বিএনপির অনেক নেতা নির্বাচন নিয়ে টালবাহানা করার অভিযোগে প্রফেসর ইউনূস সরকারের সমালোচনা করতে থাকে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায়, সেসব সমালোচনা সাধারণ সৌজন্যবোধের সীমারেখা অতিক্রম করে যায়। এতে অনেকেই অসন্তুষ্ট হন। এদের মধ্যে ফরহাদ মজহার অন্যতম। তিনি প্রশ্ন তোলেন, নির্বাচন নির্বাচন করে বিএনপি দেশের জন্য কী ফায়দা আনতে চায়। যা হোক, এ পর্যায়ে বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বিএনপির শীর্ষ নেতাদের কাছে প্রশ্ন রাখেন, সরকারের সমালোচনা করে বিএনপির কী লাভ? বেগম খালেদা জিয়ার এ উক্তিতে দৃশ্যপট পালটে যায়। বিএনপি নেতারা সরকারের সমালোচনায় রাশ টেনে ধরেন। এরপর লন্ডনে প্রফেসর ইউনূস ও তারেক জিয়ার মধ্যে বৈঠক হলে ঘোষণা আসে, ২০২৬-এর ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সেই মোতাবেক নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়।
লন্ডন বৈঠকে প্রফেসর ইউনূস ও তারেক রহমানের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত সমঝোতা জামায়াত ও এনসিপির মনঃপুত হয়নি। তাদের বক্তব্য ছিল শুধু একটি দলের সঙ্গে কথা বলে নির্বাচনের সময় ঘোষণা সঠিক হয়নি। এভাবে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির মধ্যে নির্বাচনসহ নানা প্রশ্নে ঠান্ডা যুদ্ধ চলতে থাকে। অনেক দ্বন্দ্বের মধ্যে রয়েছে পিআর ভিত্তিতে নির্বাচন অনুষ্ঠান, জুলাই সনদ প্রণয়ন এবং জুলাই সনদের আইনি কাভারেজ প্রদান। আমরা নাগরিকরা ভেবেছিলাম, ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক দলের কোনো কোনো ইস্যুতে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান থাকতে পারে এবং তা অসংগতও নয়। আশা করা গিয়েছিল রাজনৈতিক দলগুলো দেশের বৃহত্তর স্বার্থে ঐকমত্যে পৌঁছে যাবে। দেখা যাচ্ছে, কিছু কিছু মতপার্থক্যের বিষয়ে সমাধান এলেও নতুন মতপার্থক্য দেখা দিচ্ছে। এসব কারণে নির্বাচন নিয়ে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হচ্ছে। পরিস্থিতি একটু আশঙ্কাজনক হয়ে উঠলেই প্রফেসর ইউনূস বড় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করে একটি সমাধানে আসার চেষ্টা করেন। এতে কিছু সুফলও অর্জিত হতে দেখা গেছে। তারপরও প্রশ্ন উঠছে, ঘোষিত সময়মতো নির্বাচন আদৌ অনুষ্ঠিত হবে কিনা।
আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, দেশে ঘোষিত সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিকল্প নেই। যদি নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন না হয়, তাহলে বিকল্প কী? একটি বিকল্প হতে পারে এক-এগারোর মতো সামরিক বাহিনীসমর্থিত একটি সরকার গঠন। কিন্তু শেখ হাসিনা আমাদের গর্বের প্রতিষ্ঠান সামরিক বাহিনীকে যেভাবে অবনমিত করেছেন এবং এর কিছু সদস্যকে ক্ষুদ্র দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করে মানবতাবিরোধী অনেক অপরাধ সংঘটিত করিয়েছেন, তারপর সামরিক বাহিনীর পক্ষে দেশের এ জটিল মুহূর্তে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব গ্রহণ প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে। অবশ্য সামরিক বাহিনী এ ধরনের মর্যাদা ক্ষুণ্নের অবস্থায় পড়ে গেছে জেনারেল মঈনের হাত ধরে এক-এগারোর ঘটনার মধ্য দিয়ে। আমরা চাই, জাতির সবচেয়ে মূল্যবান প্রতিষ্ঠান হিসাবে সামরিক বাহিনী তার পূর্ণমর্যাদায় অধিষ্ঠিত হোক। সামরিক বাহিনী তার ক্ষুণ্ন হওয়া গৌরব ফিরে পাক।
- ট্যাগ:
- মতামত
- জাতীয় নির্বাচন
- ড. মুহাম্মদ ইউনূস