
বর্বর দশা থেকে সভ্যতায় পদার্পণ
গত ১৭ অক্টোবর জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস তার ভাষণে উল্লেখ করেন, এ সনদ একটি ঐতিহাসিক দলিল। জাতীয় ঐক্যের ক্ষেত্রে এটি একটি বড় অর্জন ও অগ্রগতি। দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার পর ঐকমত্য কমিশনের উদ্যোগে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল নতুন বাংলাদেশ গড়ার ভবিষ্যৎ রূপরেখা প্রণয়নে একমত হয়েছেন। এ অর্জনকে তিনি আমাদের (বাংলাদেশের) পুনর্জন্ম বলে উল্লেখ করেছেন।
জুলাই সনদ স্বাক্ষর বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি নজিরবিহীন ঘটনা। জুলাই সনদ স্বাক্ষরের মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো যে বিরল ঐক্যের পরিচয় দিয়েছে, তা যে কোনো বিচারেই ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। এর মাধ্যমে গত বছর জুলাই মাসে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানের চেতনা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেতে চলেছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ বলেছেন, জুলাই সনদ শুধু রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সম্পাদিত পারস্পরিক চুক্তি নয়, এটি রাজনৈতিক দল ও রাষ্ট্রের মধ্যে সামাজিক চুক্তি। আমাদের মধ্যে মতভেদ থাকবে। মতভিন্নতাও থাকবে, কিন্তু জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। স্বাক্ষরিত জুলাই সনদ দ্রুতই বাস্তবায়িত হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। জুলাই সনদ প্রণয়ন ও স্বাক্ষরের ইস্যুটি মোটেও সহজ ছিল না। নানা ধরনের বিতর্ক এবং স্বার্থের সংঘাত মাঝেমধ্যেই জুলাই সনদ প্রণয়নের কাজকে অনিশ্চিত করে ফেলত। সব প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে অবশেষে জুলাই সনদ স্বাক্ষরিত হয়েছে। এর মধ্যে দিয়ে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের পথে জাতি এক ধাপ এগিয়ে গেল। জুলাই সনদ জাতিকে আগামী দিনে নতুন আলোর পথ দেখাবে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে বেশ কয়েকবার গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তিত হয়েছে। সেসব আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল সরকার পরিবর্তন করা। আর গত বছর জুলাইয়ে ছাত্র-জনতা যে বিস্ময়কর গণ-অভ্যুত্থান ঘটায়, তা কেবল সরকার পরিবর্তনের আন্দোলন ছিল না। এর তাৎপর্য আরও অনেক গভীরে প্রোথিত ছিল। সমাজ থেকে সব ধরনের বৈষম্য দূরীকরণের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করাই ছিল জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মূল লক্ষ্য।
তবে ড. ইউনূসের এ বক্তব্য-‘বর্বর দশা থেকে আমরা এখন সভ্যতায় পদার্পণ করেছি’-আমার কাছে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে হয়েছে। গত ১৬ বছর বাংলাদেশে এক অন্ধকার যুগ নেমে এসেছিল। মানুষের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন, শোষণ-বঞ্চনা, গুম-খুন এবং সবপর্যায়ে অধিকার হরণের কাহিনি শুনলে এখনো গা শিউরে ওঠে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সেই অন্ধকার যুগের অবসান হয়। গণতান্ত্রিক, শোষণ ও বঞ্চনাহীন নতুন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জুলাই সনদ প্রণয়ন করা হয়। বস্তুতপক্ষে জুলাই সনদ একটি বৈষম্যহীন, সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায়বিচারের আদর্শের রাষ্ট্র গঠনের প্রতিশ্রুতির প্রথম পদক্ষেপ। এর বাস্তবায়নের মাধ্যমে সাম্য ও মানবিক মূল্যবোধসংবলিত এক নতুন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবে। এ প্রেক্ষাপটে তিনি বর্বর দশা থেকে সভ্য দশায় উত্তরণের কথা বলেছেন, যা আমার কাছে যথার্থই মনে হয়েছে। কিন্তু এ প্রসঙ্গে আরও কয়েকটি কথা বলা প্রয়োজন বোধ করছি।
ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। উপমহাদেশের মানুষ তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়েছিল এবং স্বাধীনতা অর্জনের আবশ্যকতা বোধ করেছিল বলেই তারা ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক আন্দোলন শুরু করতে পেরেছিলেন। মানুষ তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠলে কোনো অপশক্তিই তাদের দীর্ঘদিন দমিয়ে রাখতে পারে না। দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী ইংরেজরাও একসময় উপমহাদেশ থেকে চলে যেতে বাধ্য হয়। এ অঞ্চলের মানুষ পাকিস্তান আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিল। তাদের আশা ছিল, পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের অধীনে তারা মানবিক মর্যাদা নিয়ে বসবাস করতে পারবে। এটাও ছিল সভ্যতায় উত্তরণের একটি পর্যায়। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই তারা আশাহত হয়। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের ভোটাধিকার এবং অর্থনৈতিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। একসময় পূর্ব পাকিস্তানের অধিকারসচেতন মানুষ তাদের মর্যাদা রক্ষার জন্য আন্দোলন শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালে নয় মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। এ স্বাধীনতা অর্জনের জন্য লাখ লাখ মানুষকে জীবন দিতে হয়। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা কি আমাদের পুনর্জন্ম নয়? আমরা কি তখন সভ্য দশায় প্রবেশ করিনি?
স্বাধীনতা অর্জনের পর মানুষের প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। তারা আগের মতোই বঞ্চনার শিকার হতে থাকে। ১৯৭৫ সালের মধ্য আগস্টে রাষ্ট্রক্ষমতার পরিবর্তন ঘটে। নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে দেশ আবারও উন্নয়ন এবং মানবিক রাষ্ট্রের দিকে ধাবিত হতে থাকে। ১৯৮২ সালে এক রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে এইচএম এরশাদ নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করে নেয়। এরপর ১৯৯০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ কার্যত অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল; কিন্তু সাধারণ মানুষ সামরিক স্বৈরশাসনকে প্রশ্নাতীতভাবে মেনে নেয়নি। তারা আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকে। নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরাচারী সামরিক শাসনের অবসান ঘটে। তিনদলীয় জোটের রূপরেখা মোতাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকার রাষ্ট্র্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। দেশে গণতান্ত্রিক শাসনের যাত্রা শুরু হয়। এ অর্জনও সভ্যতার স্বাক্ষর বহন করে।
গত ১৬ বছরে দেশ আবার অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়। দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচন কোনো মহলেই গ্রণযোগ্যতা পায়নি। গুম-খুন এবং মানুষের অধিকার হরণের ঘটনা ঘটতে থাকে প্রতিনিয়ত। এ অবস্থায় সংঘটিত হয় জুলাই গণ-অভ্যুত্থান। স্বৈরাচারী সরকারের প্রধান শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হন। মানুষ এখন নতুন মানবিক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছে। বাংলাদেশ পৃথিবীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে সভ্যতার দিকে এগিয়ে চলেছে।