মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি ও অস্বীকারের চেষ্টা ক্ষণিকের প্রলাপ
“বিএলএফ ট্রেনিং শেষ করে ফার্স্ট ব্যাচ তখন আসছে ঢাকায়। দুটি গ্রুপের একটি কেরানীগঞ্জের আটিবাজারে মোস্তফা মহসীন মন্টুর নেতৃত্বে ক্যাম্প করে। আরেকটি ক্যাম্প হয় ডেমরায়, কামরুল আলম খান খসরুর নেতৃত্বে।
খসরু ভাইয়ের ক্যাম্পে যাওয়ার প্ল্যান করি আমরা। পরিকল্পনা করি লিটল কমরেডের (রফিকুল ইসলাম) সঙ্গে। সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ছোটো বোন নাজমা শাহীন বেবীসহ বাড়ি থেকে বের হই। স্কুলে যাওয়ার কথা বলে ঘর ছাড়ি। স্কুল ব্যাগের ভেতর ছিল এক সেট সালোয়ার-কামিজ, একটা গামছা, টুথব্রাশ আর একটা চিরুনি।
যাওয়ার সময় মা-বাবাকে একটা চিঠিও লিখে যাই, ‘আমরা যাচ্ছি। যদি বেঁচে থাকি বিজয়ীর বেশে ফিরে আসব। আর মরে গেলে এটাই শেষ দেখা।’
বৃত্তি পেতাম তখন। ছয় মাসের টাকা তুলে তা থেকে একশ টাকা রেখে দিই নিজের কাছে। সেটার কথাও লিখলাম চিঠিতে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পলাশী থেকে রিকশায় যাই নবাবগঞ্জের ঘাটে। এরপর নদী পার হয়ে কামরাঙ্গীর চরে। সেখানে একটা শেল্টারে থাকি দুদিন। অতঃপর লিটল কমরেড আমাদের নিয়ে যান ডেমরায়।
ডেমরা থেকেই উঠি একটা নৌকায়। উদ্দেশ্য খসরু ভাইয়ের ক্যাম্পে যাওয়া। যেতে হবে রূপসী গ্রামে, আব্দুল মোতালেবের কাছে। একসময় তিনি আর্মিতে ছিলেন। তাই মুক্তিযোদ্ধাদের শেল্টার ঠিক করা, ক্যাম্প পরিচালনা ও স্থানান্তরের যাবতীয় কাজের দায়িত্ব ছিল তার ওপর। তিনিই আমাদের কন্টাক্ট পয়েন্ট। ক্যাম্প খুঁজে পেতে সমস্যা হলে একমাত্র মোতালেব সাহেবই বলতে পারবেন খসরু ভাই কোথায় আছেন। এমনটা জেনেই রওনা হই আমরা।
কিন্তু ক্যাম্পটা ওই গ্রামে পেলাম না। কোনো কারণে স্থানান্তর করেছে। কোথায়? খোঁজ নিয়ে জানা গেল, প্যারাবো গ্রামে তারা মিয়ার বাড়িতে। ওই নৌকাতেই রওনা দিই তখন। বিকেলের দিকে পৌঁছি সেখানে।
তারা মিয়া আরেকটা বাড়ির ঠিকানা দেন। সেখানে গিয়ে পাই মোতালেব সাহেবের স্ত্রী ও মেয়ে রাজিয়াকে। তাদের সঙ্গে দেখা করে আবার তারা মিয়ার বাড়িতেই ফিরে আসি। খবর পেয়ে সন্ধ্যার দিকে মোতালেব সাহেবসহ খসরু ভাই সেখানে আসেন। একাত্তরে গেরিলা ক্যাম্পগুলো খুঁজে পাওয়ার ক্ষেত্রে এভাবেই নানা কৌশল নেওয়া হতো।
খসরু ভাই আমাদের নিয়ে যান সাদীপুর গ্রামে। ওটা ডেমরার ভেতরেই। তখন ক্যাম্পটি ছিল সেখানেই। একটা রুমে দেখলাম নদীর দিকে তাক করা আছে একটি স্টেনগান। এর পাশের রুমটিতেই থাকার ব্যবস্থা হয় আমাদের। পরদিন থেকেই খসরু ভাই ট্রেনিং দেওয়া শুরু করেন।”
একাত্তরে ট্রেনিংয়ে যাওয়ার ঘটনা এভাবেই তুলে ধরেন মুক্তিযোদ্ধা লুতফা হাসীন রোজী। আবু জায়েদ শিকদার ও মেহেরুন্নেছার প্রথম সন্তান তিনি। বাবা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক। ফলে তারা থাকতেন ফুলার রোডের ১৭ নম্বর চারতলা বিল্ডিংয়ের একতলায়। তবে তাদের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লা জেলার তিতাস উপজেলার করিকান্দিতে। মুক্তিযুদ্ধের সময় রোজী ছিলেন আজিমপুর স্কুলের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী।
আলাপচারিতায় ফিরি একাত্তরে। লুতফা হাসীন রোজী তুলে ধরেন ট্রেনিংয়ের বাকি ইতিহাস। তার ভাষায়, “গ্রেনেড ছোড়া, এলএমজি, স্টেনগান, রিভলবার প্রভৃতি চালানো শেখান খসরু ভাই। প্রতিদিন সকালে কিছু না কিছু করতাম। অস্ত্রগুলো কীভাবে ক্লিন করতে হবে, গ্রেনেড কীভাবে আন-কক ও কক করতে হয়, এগুলো হাতে কলমে শিখিয়েছেন। প্র্যাকটিসও করেছি ক্যাম্পে। বয়স কম ছিল। তাই ভয়ও লাগত। আমার কাছে সহজ ছিল স্টেনগান চালানো।
একবার বাজার থেকে খসরু ভাই দুটি শাড়ি কিনে আনেন। মেরুন শাড়িটা আমাকে আর নীল শাড়িটা দেন বেবীকে। যখন নৌকায় কোথাও যেতেন, আমাদের সঙ্গে রাখতেন। তখন সালোয়ার-কামিজের ওপর শাড়িটা পরে গ্রামের মেয়েদের মতো নৌকার সামনে বসে থাকতাম। সবাই মনে করত গ্রামের কোনো পরিবার যাচ্ছে। আনুমানিক ২০-২৫ জন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন খসরু ভাইয়ের ওই ক্যাম্পে। তবে নারী ছিলাম আমরা দুজনই।”
সাদীপুর ক্যাম্পে থাকতেই অপারেশনের মহড়া চলে কয়েকদিন। ঢাকার গোপীবাগে একটি অপারেশন করতে হবে। খসরু ভাই রোজীকে ডেকে বলেন, ‘অপারেশনে তুমিও অংশগ্রহণ করবে।’
ওই সময় আমাদের কাছে নির্দেশ ছিল নামকরা রাজনীতিবিদ, কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীদের নিরাপদে বর্ডার পার করে ভারতে পাঠিয়ে দেওয়া। যাতে তারা পাকিস্তানি আর্মির হাতে ধরা না পড়েন।
গোপীবাগ অপারেশনেও ওই কাজটি করেছিলাম। ওই অপারেশনের তিনটা টার্গেট ছিল, একটা হলো শান্তিকমিটি ও মুসলিম লীগের চেয়ারম্যানের বাড়ি অ্যাটাক।
আরেকটা হলো ফজলুল হক সাহেবের (শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক) ছেলে এ কে ফাইজুল হককে ডেকে আনা। তিনি একজন আইনজীবী, কলামনিস্ট ও রাজনীতিবিদ ছিলেন। সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে এমএনএ নির্বাচিত হয়েছিলেন। পাকিস্তানি আর্মিরা তাকে টার্গেট করেছিল। কিন্তু তার আগেই তাকে বাসা থেকে নিয়ে বর্ডারের ওপারে দিয়ে আসার নির্দেশ ছিল।
তৃতীয়টি হলো, ঢাকায় আলবদর ও আলশামস বাহিনীর এক রিক্রুটিং অফিসারকে বাড়ি থেকে ধরে আনা।”