ট্রেনের দেরি একসময় এতটাই স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল, জনপ্রিয় প্রবাদ হয়ে উঠেছিল, নয়টায় ট্রেন কয়টায় ছাড়ে? বাংলাদেশের ট্রেন সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এই অপবাদ থেকে বেশির ভাগটাই বেরিয়ে আসতে পেরেছে। দুর্ঘটনা, দুর্যোগ কিংবা উৎসবের সময়কার মাত্রাতিরিক্ত চাপে শিডিউল বিপর্যয় ছাড়া ট্রেন মোটামুটি সময় ধরেই চলাচল করে। কিন্তু কালোবাজারি ঠেকাতে যে ট্রেনের টিকিট অনলাইনে নেওয়া হয়েছে, সেটা কতটা কমেছে?
অনলাইনে টিকিট ছাড়া হয় ১০ দিন আগে। ওয়েবসাইটে ঢুকতে এক থেকে দুই সেকেন্ড দেরি করলে বেশির ভাগ রুটে আর সেই টিকিট পাওয়া যাবে না। কোথাও যাওয়ার পরিকল্পনা ১০ দিন আগে কয়জনা আর করতে পারেন! আর সেই টিকিট পাওয়ার জন্য সকাল আটটা বাজার আগে মোবাইল, কম্পিউটার কিংবা ট্যাবের সামনে বসে থাকতে পারেন! ফলে টিকিট নেই। কিন্তু যতই ডিজিটাল হোক, রেল কালো বিড়ালের আসর থেকে মুক্ত হতে পারেনি। অনলাইনে টিকিট নেই, কিন্তু টিকিট আছে কালো বিড়ালদের হাতে। তারা অস্তিত্বের তাগিদেই ডিজিটাল হয়ে উঠেছে। তারা আটটা বাজার সঙ্গে সঙ্গে দল বেঁধে টিকিট কেটে ফেলে। আর সেই টিকিট বেশি দামে বিক্রি করে। মাঝেমধ্যে ভেজাল টিকিট দিয়ে বিপত্তিতে ফেলে যাত্রীদের। এমনিতেই অ্যাপ ব্যবস্থার কারণে ৫২ লাখের মতো মানুষ ট্রেনের টিকিট কাটতে পারছে। তারপর আবার ডিজিটাল টিকিটে কালো বিড়ালের থাবা।
ইদানীং সড়কপথে কেউ যদি পরিকল্পনা করে কোথাও যেতে চান, কিংবা গিয়ে ফিরে আসতে চান, ভাগ্যের বৃহস্পতি তুঙ্গে না থাকলে তাঁর কপালে ভোগান্তি ছাড়া আর কিছু লেখা নেই। অবকাঠামো খাতের তিন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খানকেও গত সপ্তাহে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক পরিদর্শনে গিয়ে সেই অভিজ্ঞতার স্বাদ পেতে হয়েছে। তাঁর আগমন উপলক্ষে ভাঙাচোরা সড়কে আগে থেকেই ইট বিছানো হয়েছিল। রাস্তার পাশের ময়লার ভাগাড় বেড়া দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাতে শেষরক্ষা হয়নি। প্রায় দুই ঘণ্টা জ্যামে আটকে থেকে গাড়ি থেকে নেমে তাঁকে মোটরসাইকেলে রওনা হতে হয়েছিল। সাড়ে ১০টার অনুষ্ঠানে তিনি পৌঁছাতে পারেন বেলা একটার দিকে। সেই ভিডিও ভাইরালও হয়। উপদেষ্টা বলেন, যানজট শুধু রাস্তার সমস্যা নয়; এখানে ট্রাফিকে শৃঙ্খলার অভার রয়েছে। যানবাহনগুলো এলোমেলোভাবে চলাচল করে থাকে।’ যাহোক, উপদেষ্টার সফরের পর ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের সরাইলে শৃঙ্খলা ফিরেছে। গাড়ির চাপ থাকলেও যানজট আর নেই।
প্রথম আলো মহাসড়ক ও গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক সড়কগুলোর দুর্দশা নিয়ে গত মাসে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সংস্কারহীন সড়ক আর ট্রাফিক অব্যবস্থাপনা হয়ে উঠেছে জনদুর্ভোগ আর দুর্দশার সমর্থক। সম্প্রতি পাটুরিয়া–দৌলতদিয়া ফেরিঘাট এবং পদ্মা সেতু দিয়ে ঢাকা থেকে কুষ্টিয়া ও কুষ্টিয়া থেকে ঢাকায় আসা-যাওয়ার অভিজ্ঞতা হয়েছে। যাওয়া ও আসা দুই ক্ষেত্রেই ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে।
ঢাকা থেকে রওয়ানা হওয়ার আগের দিন রাতে বৃষ্টি হয়েছে। সকালে বাসা থেকে বেরিয়েই সড়কে হাঁটুপানি। ভাগ্যক্রমে সিএনজিচালিত একটি অটোরিকশা পাওয়া গেল, গন্তব্যে যেতে রাজিও হলো। কিন্তু স্বাভাবিকের চেয়ে দ্বিগুণ ভাড়া গুনতে হলো। সবটা পথ পেরিয়ে এলেও টেকনিক্যাল মোড় থেকে বিধিবাম। গাড়ি আর সামনে এগোয় না। ফলে নির্ধারিত বাস ধরতে না পারায় ভোগান্তির শুরু হলো। ভাগ্যক্রমে সদ্য এক মাস চালু হওয়া এই রুটের নতুন একটি কোম্পানির বাসে পেছনের সারির আগের সারিতে টিকিট মিলল। ঝাঁ–চকচকে বাস। বাইরে থেকে মনটা ভালো হয়ে গেল। কিন্তু ভেতরে উঠেই মোহ ভাঙল। গুমোট গন্ধ আর তেলচিটচিটে পুরোনো সিট।
শিরদাঁড়া সোজা রেখে কোনোরকমে বসা যায়। কিন্তু হাঁটুটা কসরত করেই সামনের সিটে ঠেকে যাওয়া থেকে বাঁচানো যায়। এর মধ্যে সিট ভেঙে দেওয়ার কারণে যাত্রীদের বচসাও বেধে গেল। বাসে সামনে একটা ও পিছনে ৫টা সিট এক্সটা যুক্ত করা হয়েছে।
দেখার দায়িত্ব কার? সড়ক পরিবহন সিন্ডিকেটের আসর থেকে মুক্তি দেবে কে? সামনের মুখগুলো শুধু পাল্টেছে। কিন্তু ব্যবস্থা পাল্টায়নি। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সড়কের নৈরাজ্য, অব্যবস্থাপনা, চাঁদাবাজি, সিন্ডিকিটবাজি আলোচিত ও নাগরিক উদ্বেগের বড় কারণ ছিল।
বলা হতো, রাজনৈতিক সরকারের আমলে পরিবহন ব্যবসায়ীদের সঙ্গে পুলিশ ও ক্ষমতাসীন যে শক্তিশালী নেক্সাস গড়ে ওঠে, সেখানে জনগণকে স্রেফ জিম্মি করা হয়। সেটা তো রাজনৈতিক সরকারের আমলের ব্যাপার। অন্তর্বর্তী সরকার কেন সেই নেক্সাস ভাঙতে পারল না? বরং এই সরকারের কাছ থেকে যে গোষ্ঠীরা বিশেষ সুবিধা আদায় করে নিয়েছে, তার মধ্যে সামনের কাতারে থাকবেন পরিবহন ব্যবসায়ীরাও। কথা ছিল, ২০ থেকে ২৫ বছরের পুরোনো বাস-ট্রাক রাস্তা থেকে তুলে দেওয়া হবে। সেটা তো হচ্ছেই না; বরং তাঁদের আরও বাড়তি সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। রিকন্ডিশন্ড বাস–ট্রাক আমদানির সর্বোচ্চ বয়সসীমা ৫ বছর থেকে বাড়িয়ে ১২ বছর করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এসব গাড়ি কেনার জন্য মালিকদের স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে। পাশাপাশি তাঁদের আয়করের বোঝা কমানোর দিকেও পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
যাহোক, গাবতলী থেকে আমিন বাজার পেরিয়ে হেমায়েতপুরের আগে বন্ধ হয়ে গেল গাড়ির চাকা। সেই যে বন্ধ হলো, সচল হতে লেগে গেল পাক্কা দেড় ঘণ্টা। রাস্তার পাশে উচ্ছেদ অভিযান। তাই সড়ক বন্ধ। যাক, দেড় ঘণ্টার মধ্যেই মুক্তি মিলল। ফেরিঘাটে পৌঁছে ফেরি নেই। সেখানেও ঘণ্টাখানেক বসে থাকা।
এরপর ঘাট পেরিয়ে কিছুদূর যাওয়ার পর রেলক্রসিংয়ের আগে এসে থেমে গেল বাস। সেখানেও পাক্কা সোয়া ঘণ্টা। এখানে কেন যে বাসের চাকা থেমে থাকল, তার উত্তর কেউ দিতে পারল না। রাজবাড়ী এসে জেলা পরিবহন মালিক সমিতির ষন্ডাপান্ডারা পাকড়াও করল যাত্রীসমেত বাসটি। সুপারভাইজারের সঙ্গে দেনদরবার ও লেনদেন শেষে মুক্তি মিলল। বলা চলে শনির দশা কাটল। শেষে গন্তব্যে পৌঁছানো গেল। একটি স্মরণীয় জার্নি বাই বাস। রচনা লিখলে ১০-এ অন্তত সাড়ে ৭ পাওয়া যেত। কিন্তু সাড়ে ৪ ঘণ্টার জার্নি শেষ করতে পাক্কা ৯ ঘণ্টা চলে গেছে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- বেহাল সড়ক
- সংস্কার কাজ