বাংলাদেশই তার একমাত্র ঠিকানা
শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ‘প্রথম বাংলাদেশ আমার, শেষ বাংলাদেশ’-এর যে বীজমন্ত্র উচ্চারণ করেছিলেন, বেগম খালেদা জিয়া সে বীজমন্ত্রকে জীবনমন্ত্রে পরিণত করেছিলেন। জীবনে ও মরণে তিনি বাংলাদেশ, বাংলাদেশের মানুষ ও মাটিকে ধারণ করেছিলেন। শত নির্যাতন, ভয়-ভীতি, প্রলোভনে তিনি এক মুহূর্তের জন্যও বাংলাদেশ ছেড়ে যাননি। দৃঢ়চিত্তে ও সগৌরবে বারবার ঘোষণা করেছিলেন, ‘বাংলাদেশের বাইরে আমার কোনো ঠিকানা নেই।’ মঙ্গলবার (৩০ ডিসেম্বর) শীতার্ত প্রত্যুষে বেগম খালেদা জিয়ার চিরবিদায়ের শোকে পুরো বাংলাদেশ এবং দেশের মানুষ বিচ্ছেদ-বেদনায় স্তব্ধ-পুরো বাংলাদেশই রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছে তার ঠিকানায়।
জাতির আকাঙ্ক্ষা, আবেগ ও প্রত্যাশার সমান্তরালে মিলেমিশে একাকার হওয়া রাজনৈতিক জীবন ইতিহাসে খুব একটা দেখা যায়নি। তার দৃঢ়তা, সততা, দেশপ্রেম ও সাহসিকতার মাধ্যমেই একজন নেতা নিজেকে জাতীয় নেতার পর্যায়ে উন্নীত করতে পারেন। সমকালীন ইতিহাসে বেগম খালেদা জিয়া ছিলেন এমন এক রাজনৈতিক নেতা, যিনি শ্রমে-ঘামে, মেধায়-মননে এবং কঠোর ত্যাগ-তিতিক্ষা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে নিজেকে জাতীয় নেতার হীরন্ময় দ্যোতিতে উদ্ভাসিত করেছেন। বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাস ও রাজনৈতিক পরিক্রমায় নিজেকে তিনি পরিণত করেছেন এক ও অবিচ্ছেদ্য অংশে।
তিনি ছিলেন ইতিহাসের বরদান। ধ্বংসপ্রাপ্ত বাংলাদেশের পুনরুদ্ধার ও গণতন্ত্রায়নের ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল। সামরিক স্বৈরতন্ত্র আর ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের সম্রাজ্ঞী সুলতানা রাজিয়া। ৪১ বছরের রাজনৈতিক জীবনে অন্তত পাঁচবার কারাভোগ করেছেন তিনি। জেলখানায় এবং প্রতিপক্ষে হিংসা ও আঘাতে জর্জরিত হয়ে রোগশয্যায় জীবনের দীর্ঘবছর কাটিয়েছেন তিনি। বাংলাদেশের তিনবারের প্রধানমন্ত্রী হয়েও তিনি ব্যক্তিগত স্বার্থ ত্যাগ করেছেন জাতির প্রয়োজনে। স্বামী ও সন্তান হারানোর বেদনা বয়ে চলেছেন একাকী, একান্তে। কিন্তু কোনো বিরূপতা ও আক্রমণের পরও তিনি বাংলাদেশ ও দেশের মানুষকে ছেড়ে যাননি।
উন্নয়নমুখী গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের পথে চলেছেন তিনি জীবনভর। তার শাসনকালে উদার, বহুত্ববাদী, সমন্বয়মূলক গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বিকশিত হয়েছিল। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নানা শাঠ্য-ষড়যন্ত্র করেও তাকে দুর্নীতির কালিমা দিতে পারেনি। সততা ও সাহসের সঙ্গে তিনি সব সমালোচনা ও চক্রান্ত মোকাবিলা করে বিজয়ী হয়েছেন। সিক্ত হয়েছেন দেশবাসীর শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও সমর্থনের ফল্গুধারায়।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একজন গৃহবধূ, একজন দলীয় প্রধান, একজন প্রধানমন্ত্রী হয়েও তিনি ছিলেন সমগ্র জাতির অভিভাবকস্বরূপ এবং স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সংরক্ষক। দলীয় অবস্থানের বাইরে তার ছিল উজ্জ্বল জাতীয় উপস্থিতি। দল-মত নির্বিশেষে সবার জন্য তিনি ছিলেন আস্থা ও বিশ্বাসের প্রতীক। তার রাজনীতির মতোই সামাজিক, সাংস্কৃতিক অবস্থান ছিল সদাচার, সৌহার্দ ও সৌন্দর্যের দৃষ্টান্ত। বাংলাদেশের বিভাজিত ও দ্বন্দ্বমুখর রাজনীতিতে বেগম খালেদা জিয়া ছিলেন সবার জন্য সম্মানজনক সহাবস্থানের রাজনীতির প্রবক্তা। তার যুগে তিনি ছিলেন অগ্রণী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। উন্নয়নশীল বিশ্বের সামনে নিয়মতান্ত্রিক গণআন্দোলনের প্রণোদনা জাগ্রত করেন তিনি। স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তী বিশ্ব রাজনীতিতেও তার অবস্থান ছিল অগ্রগণ্য। তিনি তার যুগের গণতান্ত্রিক প্রত্যাশাকে পরিপূর্ণ করেছিলেন। বিশ্বের সামনে বাংলাদেশকে স্থাপন করেছিলেন সামরিক স্বৈরতন্ত্রের ধ্বংসস্তূপ থেকে গণতান্ত্রিক পুনরাভিযানের সারথি রূপে।
ক্ষমতার লোভে দলের সবাই যখন দল ছেড়ে চলে গিয়েছিল, তখন তিনি আপসহীন প্রতিমূর্তিতে রাজপথে অবতীর্ণ হন। তিনি জনমানুষের নেত্রী রূপে রাজপথে থেকে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের লড়াই জারি রাখেন। বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে মুক্ত ও স্বাধীন করার ঐতিহাসিক মাইলফলক নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের তিনি নেতৃত্ব দেন। সংসদীয় গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে পালন করেন যুগান্তকারী ভূমিকা। ধারাবাহিকভাবে অবদান রাখেন বাংলাদেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির প্রতিটি পর্যায়ে। গণতন্ত্র ও জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় তার আপসহীন ভূমিকা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
দেশ, জাতি ও গণতন্ত্রের কল্যাণে তিনি যেমন আপস করেননি, তেমনিভাবে দলের স্বার্থও দেখেননি। দলের রাষ্ট্রপতিশাসিত নীতি তার উদারতা ও মহত্ত্বের কারণে সংসদীয় গণতন্ত্রের মোহনা খুঁজে পায়। দলের বহু সিদ্ধান্তকে তিনি জাতীয় স্বার্থের প্রয়োজনে পরিত্যাগ করতেও দ্বিধা করেননি। দেশের জাতীয় রাজনৈতিক ইতিহাসের ধারাক্রমে যেসব জাতীয় নেতা চিরস্মরণীয় ও অম্লান হয়ে আছেন, তিনি স্বকীয় কর্ম ও কীর্তির মাধ্যমে নিজেকে সে উচ্চাসনে প্রতিস্থাপিত করেছেন।
৩০ তারিখ বাংলাদেশের ইতিহাসে বেদনাবহ আবহ জাগাবে যুগ-যুগান্তর ধরে। ৩০ মে আর ৩০ ডিসেম্বর শোকাবহ অনুরণন তুলবে সারা বাংলাদেশে। শহীদ জিয়ার ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারের রাজনৈতিক যাত্রাপথে বেগম জিয়াকে দেখা যাবে জনশ্রদ্ধায় পুষ্পিত বাংলাদেশে। জীবনের মতো মরণেও যে বাংলাদেশই তার একমাত্র ঠিকানা।