খালেদার রাজনীতি ছিল সম্মানের, বিদায়ও হলো সম্মানের
বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া চলে গেলেন। ফিরে গেলেন সৃষ্টিকর্তার কাছে, ঠিক যেমনটি সুরা আল বাকারায় বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আমরা আল্লাহর জন্য এবং নিশ্চয়ই আমরা তাঁর কাছেই ফিরে যাব।’
খালেদা জিয়া হাসপাতালে সিসিইউ এবং আইসিইউতে কাটাচ্ছিলেন কয়েক সপ্তাহ ধরে। তিনি যেন তাঁর বড় ছেলে তারেক রহমানের প্রতীক্ষাতেই ছিলেন। এরপর তারেক রহমান এলেন, বেগম জিয়া চলে গেলেন।
বাংলাদেশের ৫৪ বছরের ইতিহাসে বেগম খালেদাই একমাত্র সরকারপ্রধান, যিনি নিজের সম্মান অক্ষুণ্ন রেখে ক্ষমতা ছেড়েছেন এবং স্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণ করেছেন। তিনি ছিলেন একজন সম্মানিত নারী, যিনি নিজের সম্মানকে ক্ষমতার চেয়েও বেশি মর্যাদা দিতেন।
বেগম জিয়া ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় যতটুকু সম্মানিত ছিলেন, ক্ষমতার বাইরে অবস্থান করে তিনি তার চেয়ে কম সম্মানিত ছিলেন না।
একজন গৃহবধূ ও অনিচ্ছুক রাজনীতিবিদ কীভাবে তিন তিনবার প্রধানমন্ত্রী হলেন এবং কীভাবে একটা কোন্দলগ্রস্ত ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন রাজনৈতিক দলকে একত্র করে বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল হিসেবে রেখে গেছেন, তা খুঁজে বের করতে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ইতিহাসবিদদের তাঁর সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের অনেক বিষয় নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে হবে।
মৃদু হাসির আড়ালে তিনি ছিলেন একজন কঠোর রাজনীতিবিদ। কঠোর না হলে তিনি এত বড় একটি রাজনৈতিক দলে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে পারতেন না। তবে তাঁর কঠোরতার মধ্যে কোনো হিংস্রতা ও রুক্ষতা ছিল না।
ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে বেগম জিয়া যখন রাষ্ট্রপতি বানালেন, তাঁদের মধ্যে প্রোটোকল নিয়ে মতবিরোধ দেখা দিল। তিনি নিয়মমাফিক দলের পার্লামেন্টারি বোর্ডের ওপর ছেড়ে দিলেন এটি সমাধান করার জন্য।
বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে সম্মানজনকভাবে পদত্যাগ করার সুযোগ দেওয়া হলো। দলের চেয়ারপারসন হিসেবে তখন বা তার পরেও এ ঘটনা নিয়ে তিনি প্রকাশ্যে কোনো উচ্চবাচ্য করেননি।
এর সঙ্গে শেখ হাসিনা কর্তৃক সাবেক বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে ভয়ভীতি দেখিয়ে হেনস্তা করার ঘটনার তুলনা করলে দুজনের পার্থক্যটা পরিষ্কার বোঝা যায়।
জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি থাকা অবস্থায়। জিয়াউর রহমানের হত্যার পর খালেদা জিয়া অনেকটা ছিলেন রাজনীতিবিমুখ। তা ছাড়া তখন অনেকেই চাইত না বেগম জিয়া রাজনীতিতে আসুন।
বিএনপির প্রয়াত নেতা মওদুদ আহমদ তাঁর বই ‘চলমান ইতিহাস’-এ লিখেছেন, ‘বেগম জিয়া দলের চেয়ারম্যান হোন এটি সামরিক নেতারা, দুই গোয়েন্দা বিভাগ এবং মন্ত্রিসভার দুই গ্রুপ—কেউই চায়নি। তাই বিচারপতি সাত্তারই হলেন বিএনপির চেয়ারম্যান ও রাষ্ট্রপতি।’
এরশাদের সামরিক শাসনের পর বিচারপতি সাত্তারকে রাষ্ট্রপতি ও পরবর্তীকালে বিএনপি চেয়ারম্যানের পদ ছাড়তে হলো। বাংলাদেশের রাজনীতিতে যাত্রা শুরু হলো খালেদা জিয়ার।
রাষ্ট্রপতি জিয়াকে যাঁরা হত্যা করেছিলেন বা হত্যাকাণ্ডে যাঁরা জড়িত ছিলেন বলে অভিযুক্ত হয়েছিলেন, তাঁরা বিভিন্নভাবে কঠিন শাস্তি পেয়েছিলেন। বেগম জিয়ার মধ্যে তাই রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার মধ্যে প্রতিশোধের কোনো প্রবণতা ছিল না।
তাঁর মূল বাধ্যবাধকতা ছিল রাষ্ট্রপতি জিয়ার রাজনৈতিক ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকার রক্ষা করা। জিয়ার মৃত্যুর পর এম এ মতিন, জামাল উদ্দিন আহমেদ ও শাহ আজিজুর রহমানের উপদলীয় কোন্দলে বিএনপি একটি অকেজো রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়েছিল।