
গণভোটে বিভাজনের ঝুঁকি এড়ানোর উপায় কী
রাজনৈতিক দলগুলো যখন নিজেদের ভেতর একধরনের টানাপোড়েন ও আস্থাহীনতার সংকটে ভুগছে, তখন জুলাই সনদের মধ্য দিয়ে একটি ঐকমত্যের দিকে এগিয়ে যাওয়া আমাদের জন্য আশার আলো দেখায়। প্রস্তাবিত বিভিন্ন রাজনৈতিক সংস্কার, জবাবদিহি এবং দেশের সামগ্রিক উন্নয়নপ্রক্রিয়ার জন্য জুলাই সনদ একটি কার্যকর দলিল হিসেবে রাজনৈতিক দল ও জনগণের সামনে থেকে যাবে।
জুলাই সনদ তৈরির অন্যতম মূল লক্ষ্য হলো দলীয় প্রভাবমুক্ত মানবিক রাষ্ট্র গঠনের মধ্য দিয়ে নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করা এবং রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সংস্কারের মধ্য দিয়ে শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তোলা। তাই জুলাই সনদের গুরুত্ব বিবেচনায় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একে কেন্দ্র করে জনগণের ম্যান্ডেট বা সমর্থন পাওয়ার প্রক্রিয়া হিসেবে গণভোটের প্রস্তাব সামনে আসে।
গণভোটের মধ্য দিয়ে যদি জুলাই সনদের বৈধতা নিয়ে আসা যায়, তাহলে রাজনৈতিক দলগুলোর এই সনদের প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন করা ভবিষ্যতের জন্য অনেক সহজ হয়ে উঠতে পারে।
সবচেয়ে বড় বিষয় হলো রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের প্রতি একভাবে দায়বদ্ধ থাকবে, যেখানে জনগণ বলতে পারবে যে জুলাই সনদকে সরাসরি তারাই বৈধতা দিয়েছে। এতে করে জনগণের অংশগ্রহণ রাষ্ট্রীয় পরিসরে বৃদ্ধি পাবে এবং জনগণও রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আস্থাশীল হতে শুরু করবে যে রাজনৈতিক আস্থা বিগত সময়ে আমাদের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অনুপস্থিত ছিল।
রাজনৈতিক দল ও জনগণের মধ্যে আস্থা এবং জবাবদিহিমূলক সম্পর্ক তৈরির জন্য গণভোট কার্যকর মাধ্যম হতে পারে। গণভোট হচ্ছে জনগণের বৈধতা পাওয়া ও আস্থা অর্জন করার একটি কার্যকর ও গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম, সেটি আমরা বিগত সময়ে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত কয়েকটি গণভোটে দেখেছি; যদিও এর মধ্যে বিতর্কিত গণভোটের উদাহরণও রয়েছে। তবে সাম্প্রতিক বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গণভোট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে, যদি এটিকে সঠিক ও নিরপেক্ষভাবে বাস্তবায়ন করা যায়। যদিও কোনো কোনো বিশ্লেষক মনে করছেন যে গণভোটের মাধ্যমে জনমনে আরও বিভাজনের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
এসব কারণে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের জন্য গণভোটের প্রস্তাব সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক মহলে বড় আলোচনার জন্ম দিয়েছে। গণভোট আয়োজনের ক্ষেত্রে সাংবিধানিক ও আইনগত সীমাবদ্ধতার কথা যেমন আসছে, তেমনি গণভোট আয়োজন করার প্রক্রিয়া নিয়েও ভিন্নমত দেখা দিয়েছে। বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো যেমন ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের দিনেই গণভোট আয়োজনের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরছে, তেমনি জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি প্রস্তাব করছে নির্বাচনের আগেই গণভোট করার। যদিও এনসিপি আগে বলেছিল যে তারাও জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোটের পক্ষে।
তবে এমন তাড়াহুড়া করে গণভোট আয়োজন করা কতটা যুক্তিযুক্ত হবে, সেটি আমাদের সতর্কভাবে ভেবে দেখতে হবে। কেননা, এখানে বেশ কয়েকটি সীমাবদ্ধতার বিষয় আমরা উল্লেখ করতে পারি। প্রথমত, জুলাই সনদ নিয়ে জনগণের মধ্যে যথাযথ জ্ঞান রয়েছে কি না, সেটি মূল্যায়ন করা। জনগণের মধ্যে যদি জুলাই সনদ নিয়ে পরিষ্কার ধারণা না থাকে, তাহলে গণভোট আয়োজনের প্রধান যৌক্তিকতা বিফলে যাবে, যদি জনগণ এই গণভোটকে প্রত্যাখ্যান করে। এতে করে জুলাই সনদে স্থান পাওয়া গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো উপেক্ষিত থেকে যেতে পারে।
দ্বিতীয় বিষয়টি হলো, জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট আয়োজন করার জন্য আমাদের হাতে পর্যাপ্ত সময় নেই। আবার গণভোটের জন্য নির্বাচন পেছানোর যুক্তি নিয়ে এলে দেশ আরও সংকটের মধ্যে পড়বে। তৃতীয়ত, জনগণকে প্রস্তুত না করে ও যথাযথ প্রচার না চালিয়ে গণভোট আয়োজিত হলে ভোটারদের উপস্থিতির সংখ্যা নিয়ে আশঙ্কা থেকে যেতে পারে, যেমনটি এ বছর জুনে ইতালিতে অনুষ্ঠিত শ্রম ও নাগরিকত্ব আইন পরিবর্তনের গণভোটের সময় দেখা যায় যা গণভোটকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।