
ফিলিস্তিনের স্বীকৃতি হামাসের পুরস্কার নয়
যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সসহ বেশকিছু পশ্চিমা শক্তি অবশেষে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু এই স্বীকৃতি এত দেরিতে আসায় অনেকেই মনে করেন, গাজায় হাজারো মৃত্যুর দায় এই দেশগুলোর ওপরও বর্তায়, বিশেষ করে যখন এই মৃত্যুগুলো ঠেকানো যেত। তারপরও পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাবান ব্যক্তি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মনে করেন, ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার অর্থ হলো হামাসকে পুরস্কৃত করা। হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলিন লেভিট সাংবাদিকদের বলেছেন, 'সত্যি বলতে, তিনি (ট্রাম্প) মনে করেন, এটা হামাসের জন্য পুরস্কার।'
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনে বক্তৃতার সময় ট্রাম্প আবারও ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়া দেশগুলোর বিষয়ে আক্রমণাত্মক কথা বলেছেন। গাজাকে 'মধ্যপ্রাচ্যের রিভিয়েরা' বানানোর প্রস্তাব দেওয়া ট্রাম্পের পাশাপাশি, আশ্চর্যজনকভাবে ব্রিটেনের বেশকিছু প্রভাবশালী গণমাধ্যমও ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সুরেই বলছে, এটা নাকি সন্ত্রাসের কাছে আত্মসমর্পণ।
ব্রিটিশ গণমাধ্যমের শিরোনামগুলো ছিল একেবারেই হতবাক করার মতো এবং ফিলিস্তিনি জনগণকে অবমাননার জলজ্যান্ত উদাহরণ। ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়ে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের ঘোষণার পরদিন ডেইলি মেইল বড় করে ছাপিয়েছে—হামাসের বিজয় দাবি। দ্য টাইমসও একই পথে হেঁটেছে। ইসরায়েলি জিম্মিদের পরিবারকে উদ্ধৃত করে বলেছে, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী নাকি হামাসকে 'সবচেয়ে বড় পুরস্কার' দিয়ে দিয়েছেন। টেলিগ্রাফও একইভাবে শিরোনাম করেছে—ফিলিস্তিনকে যুক্তরাজ্যের স্বীকৃতির পর হামাসের বিজয় ঘোষণা।
কিছু ব্যতিক্রমও ছিল। তেমন উদাহরণ যারা তৈরি করেছে, তারা উদারপন্থী ও বামঘেঁষা হিসেবেই পরিচিত। দ্য মিররের প্রথম পাতায় গাজায় ধ্বংসপ্রাপ্ত ভবনের ছবি দিয়ে লেখা হয়েছে—শান্তির সর্বোচ্চ প্রত্যাশা। দ্য গার্ডিয়ান উদ্ধৃত করেছে স্টারমারের সেই বক্তব্য যেখানে তিনি বলেছিলেন, এই সিদ্ধান্ত 'দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের প্রতি প্রতিশ্রুতি'।
কিন্তু সামগ্রিক সুর ছিল ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার বিরোধী।
অনেক দিন ধরেই অভিযোগ আছে, পশ্চিমা মূলধারার গণমাধ্যম ফিলিস্তিনিদের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করছে। মুসলিম কাউন্সিল অব ব্রিটেনের উদ্যোগে গঠিত সেন্টার ফর মিডিয়া মনিটরিং দেখিয়েছে, বিবিসির উপস্থাপকরা অন্তত ১০০ বার গণহত্যার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছেন। অথচ নেতানিয়াহুর 'আমালেক' প্রসঙ্গসহ ইসরায়েলি নেতাদের প্রকাশ্য গণহত্যার বক্তব্য কখনোই উল্লেখ করেননি।
গত জুনে সেন্টার ফর মিডিয়া মনিটরিং প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ৩৫ হাজারের বেশি বিবিসি কনটেন্ট বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ফিলিস্তিনিদের তুলনায় ইসরায়েলিদের মৃত্যুকে ৩৩ গুণ বেশি কাভারেজ দেওয়া হয়েছে এবং চার গুণ বেশি আবেগপূর্ণ ভাষায় ইসরায়েলিদের মৃত্যুর তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক সাতটি ও আন্তর্জাতিক তিনটি টেলিভিশনের এক লাখ ৮০ হাজার ভিডিও ক্লিপ, ২৮টি ব্রিটিশ গণমাধ্যমের ওয়েবসাইট থেকে ২৬ হাজার সংবাদ প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করেও ইসরায়েলের প্রতি পক্ষপাতিত্বের একই ধারা দেখতে পাওয়া যায়। যদিও বিবিসি এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা বলেছে, 'আমরা মনে করি না যে শব্দ গণনা করে যথাযথ নিরপেক্ষতা পরিমাপ করা যেতে পারে। আমরা আমাদের নিজস্ব স্বাধীন সম্পাদকীয় সিদ্ধান্ত নিই এবং এর বাইরের যেকোনো পরামর্শ প্রত্যাখ্যান করি।'
এটা কেবল ফিলিস্তিনিদের দুর্ভোগকে ছোট করে দেখা নয়, বরং প্রায় দুই বছর ধরে বিরামহীনভাবে চলা ইসরায়েলি নিপীড়ন ও যুদ্ধাপরাধকে ইচ্ছাকৃতভাবে আড়াল করা। বাইরের কোনো সাংবাদিক ঢুকতে না পারলেও গাজায় ইসরায়েলি গণহত্যা পুরো দুনিয়া সরাসরি দেখতে পারছে। আল জাজিরাকে গাজায় ঢুকতে দেওয়া হয়নি, বিদেশি সাংবাদিকদের ঢুকতে দেওয়া হয়নি, আর স্থানীয় সাংবাদিকদের নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে।