
ঘুরে দাঁড়ানোর উদাহরণ হতে পারে শ্রীলঙ্কা
তিন বছর আগে শ্রীলঙ্কায় ঘটে যাওয়া ব্যাপক বিক্ষোভ, সরকার পতনের ঘটনা এখনো সবার মনে আছে। কেন সে বিক্ষোভ হয়েছিল, সেটাও অজানা নয় কারও। ২০২২ সালের জুলাইয়ে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের দেশ ছেড়ে পলায়ন, প্রেসিডেন্টের বাসভবনে ঢুকে তাঁর বিছানায় শুয়ে বিক্ষোভকারীদের ছবি তোলা, সুইমিংপুলে সাঁতার কাটার ঘটনা বিশ্বজুড়ে সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছিল। তবে বিক্ষোভ-পরবর্তী তিন বছরে শ্রীলঙ্কায় কী ঘটে গেছে, তা নিয়ে আলোচনা কমই হয়।
ব্যাপক দুর্নীতি আর সরকারের বিলাসী ব্যয়ের কারণে অর্থনীতি ধসে পড়া, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে জীবন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠাই ছিল শ্রীলঙ্কার সেই বিক্ষোভের মূল কারণ। পাশাপাশি বেকারত্বের হার দিন দিন বৃদ্ধি, রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক দুরবস্থায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়াসহ আরও অনেক কারণ ছিল এই ক্ষোভের পেছনে। যে সময় শ্রীলঙ্কার মানুষ ঘর ছেড়ে পথে নেমেছিল, তখন দেশটির মূল্যস্ফীতির হার ছিল রেকর্ড ৬৯ দশমিক ৮ শতাংশ। দরিদ্র মানুষের জন্য যখন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের উচ্চমূল্যের কারণে দিন পার করা কঠিন হয়ে পড়েছিল, তখন ধনীদের জীবন ছিল বিলাসিতায় ভরপুর। বিশেষ করে ক্ষমতার ভরকেন্দ্রের আশপাশের মানুষের জীবন যেন অর্থনীতির ভঙ্গুর দশার উল্টো সাক্ষ্য দিচ্ছিল। অথচ সাধারণ মানুষকে তখন জ্বালানি তেল কিনতেও লম্বা লাইনে দাঁড়াতে হচ্ছিল। এমনকি কড়া রোদে দীর্ঘ সময় লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে প্রাণহানির ঘটনাও সংবাদ শিরোনাম হয়েছে।
একদিকে সাধারণের জীবন ওষ্ঠাগত, অন্যদিকে দেশজুড়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াচ্ছিল একের পর এক সুউচ্চ অট্টালিকা আর ভাস্কর্য। এর সবই হচ্ছিল ঋণের টাকায়। অর্থনীতি বোঝেন না—এমন সাধারণ মানুষও জানেন, সরকার যে ঋণ নেয় তার সুদসমেত পুরোটা চোকাতে হয় জনগণকেই, তার ট্যাক্সের টাকায়। এভাবে দিন দিন দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে রাজপথে নেমে এসেছিল শ্রীলঙ্কার জনগণ। বিক্ষোভে গোতাবায়া রাজাপক্ষের সরকারের পতনের পর শ্রীলঙ্কানরা আবার ঘরেও ফিরে যায়। রাজাপক্ষের দেশ ছেড়ে পালানোর এক সপ্তাহের মধ্যে দেশটির পার্লামেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহেকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করে। তারপর যেন ভিন্ন গল্প রচিত হতে শুরু করে দেশটিতে।
সাম্প্রতিক খবর হচ্ছে, শ্রীলঙ্কা এক মধুর সংকটে পড়েছে। অবশ্য সংকটটাকে ‘মধুর’ বলা হলেও তা দীর্ঘ মেয়াদে রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকরই। এই সংকটও দ্রব্যমূল্য নিয়ে। দেশটিতে ২০২২ সালের নভেম্বরেই অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। এরপর ২০২৩ সালে দ্রব্যমূল্য কমে যেতে শুরু করে। দিন দিন এভাবে দ্রব্যমূল্য কমে যাওয়া, অর্থাৎ মূল্যসংকোচনও অর্থনীতির জন্য অশনিসংকেত। আর তাই তো শ্রীলঙ্কার সরকার উঠেপড়ে লেগেছে, কীভাবে দ্রব্যমূল্য বাড়ানো যায়। পরপর দুই বছর এভাবে মূল্যসংকোচন অনেকটা ভাবিয়ে তুলেছিল সরকারকে। অবশেষে দেশটিতে জিনিসপত্রের দাম বাড়তে শুরু করেছে। গত সেপ্টেম্বরে ১৪ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি রেকর্ড করেছে দেশটি। এ মাসে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১ দশমিক ৫ শতাংশ। তার আগের মাসে গত আগস্টে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১ দশমিক ২ শতাংশ। অথচ এক বছর আগে ২০২৪ সালের আগস্টে মূল্যসংকোচন ঘটেছিল শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ।
আমি অর্থনীতি ততটা বুঝি না। তবে সামান্য পড়ালেখার সুবাদে এটুকু বুঝেছি, একটি দেশের অর্থনীতির জন্য মূল্যস্ফীতি ৫ শতাংশ বা তার খুব কাছাকাছি থাকা আবশ্যক। শ্রীলঙ্কার সরকার এখন সেই চেষ্টাটাই করে যাচ্ছে। দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক আভাস দিয়েছে, দ্রব্যমূল্য এই বছর আরও বাড়বে এবং বছরের শেষ নাগাদ গিয়ে হয়তো মূল্যস্ফীতি ৫ শতাংশের লক্ষ্যমাত্রা স্পর্শ করবে।
এভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর পেছনে অবশ্য আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) একটি ভূমিকা আছে। সংস্থাটি ২০২৩ সালের শুরুর দিকে দেশটিকে ২৯০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ সহায়তা দিয়েছিল। সে অর্থের উপযুক্ত ব্যবহারের কারণে এভাবে এত অল্প সময়ে ঘুরে দাঁড়ানো গেছে।
শ্রীলঙ্কার এই ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প বিশ্বের অনেক দেশের জন্যই উদাহরণ হতে পারে। বিশ্বে এমন অনেক দেশ আছে, যারা দিনের পর দিন, বছরের পর বছর দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে লড়ছে।
বিশ্লেষকদের মতে, বিক্ষোভ-পরবর্তী সময়ে শ্রীলঙ্কায় যখন দ্রব্যমূল্য কমতে শুরু করে, সাধারণ মানুষ আবারও তাদের ব্যয় বাড়িয়েছে। এদিকে ব্যবসা ও অবকাঠামোয় বিনিয়োগ বেড়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে পর্যটন। শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির মেরুদণ্ড বলা চলে পর্যটনকে। বিক্ষোভ-পরবর্তী সময়ে সারা দুনিয়া থেকে পর্যটকেরা দেশটিতে ভ্রমণ করছেন। ফলে অর্থনীতির চাকা জোরেশোরে ঘুরতে শুরু করেছে। ২০২৫ সালের প্রথম প্রান্তিকে শ্রীলঙ্কায় মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪ দশমিক ৮ শতাংশ। ২০২৪ সালে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৫ শতাংশ।
- ট্যাগ:
- মতামত
- অর্থনৈতিক অবস্থা
- ঘুরে দাঁড়ানো