স্বাধীন বিচার বিভাগের জন্য সব বাধা কি কেটেছে
সুপ্রিম কোর্টের অধীনে একটি পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠার শেষ ও সবচেয়ে বড় বাধা কাগজে–কলমে দূর হয়েছে। গত ২ সেপ্টেম্বর বিচারপতি আহমেদ সোহেল ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বিভাগের দ্বৈত বেঞ্চ মো. সাদ্দাম হোসেন ও অন্যান্য বনাম বাংলাদেশ সরকার ও অন্যান্য (রিট আবেদন নং ১০৩৫৬/২০২৪) মামলায় জেলা আদালতের (অধস্তন আদালত) বিচারকদের পেশাগত নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত করা–সংক্রান্ত সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদে আনীত সংশোধনীগুলোকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করেন।
এই রায়ের মধ্য দিয়ে বিচার বিভাগের পৃথক্করণ ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে নাগরিক ও রাজনৈতিক অঙ্গীকারের পথে বিছিয়ে রাখা পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ দ্বৈতশাসনের ‘কাঁটাগুলো’ অপসারিত হয়েছে বলা যায়।
সর্বোচ্চ আদালত এর আগে অষ্টম ও ষোড়শ সংশোধনী মামলার রায়ে বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে সংবিধানের মৌলিক কাঠামো (সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে যেগুলো বদলানো যায় না) বলে সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন। সেই সব সিদ্ধান্তের আলোকেই সাম্প্রতিক এই রায়ে চতুর্থ ও পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ১১৬ অনুচ্ছেদে করা পরিবর্তগুলো মৌলিক কাঠামোর সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ বলে বাতিল করে দেওয়া হয়েছে।
২০১৭ সালের জুডিশিয়াল সার্ভিস (শৃঙ্খলা) বিধিমালার মাধ্যমেও বিচারকদের নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি নির্বাহী বিভাগ বা সরকারের হাতে রাখা হয়েছিল। আলোচিত এই রায়ে সেটাকে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করে বাতিল করা হয়।
এ রায়ে বলা হয়, ১১৬ অনুচ্ছেদ যেমন ছিল, ঠিক তেমনভাবেই তা পুনরুজ্জীবিত হয়ে সংবিধানে পুনঃস্থাপিত হবে এবং এই রায় ঘোষণার দিন থেকেই তা কার্যকর ধরা হবে। আদালত একই সঙ্গে রায়ের অনুলিপি প্রাপ্ত হওয়ার তিন মাসের মধ্যে বিচার বিভাগের জন্য আলাদা সচিবালয় গঠন করার নির্দেশ দেন।
অধস্তন আদালতের বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ–সংক্রান্ত সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ তিনবার সংশোধন করা হয়েছিল; চতুর্থ, পঞ্চম ও পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে। এর মধ্যে পঞ্চম সংশোধনী আগেই চূড়ান্তভাবে রদ/রহিত হয়েছিল সর্বোচ্চ আদালতের সিদ্ধান্তে। এবার বাকি দুটি সংশোধনীকে অসাংবিধানিক ঘোষণার ফলে এই অনুচ্ছেদ তার আদিরূপে ফেরে।
১১৬ অনুচ্ছেদের আদিরূপটি ছিল: বিচারকর্ম বিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তিদের এবং বিচার বিভাগীয় দায়িত্ব পালনে রত ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ (কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি দান, ছুটি মঞ্জুরিসহ) ও শৃঙ্খলাবিধান সুপ্রিম কোর্টের ওপর ন্যস্ত থাকিবে।
২.
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এ অঞ্চলের মানুষের প্রায় দেড় শ বছরের পুরোনো এক দাবি বা আকাঙ্ক্ষা। ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনামলে ১৮৮৫ সালে ভারতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পরপরই এর অন্যতম উদ্যোক্তা এবং প্রথম বাঙালি ব্যারিস্টার মনমোহন দত্ত এই দাবি উত্থাপন করেন। তিনি বিষয়টি নিয়ে নানা কর্মসূচি পালন ও লেখালেখি শুরু করেন।
শিবনাথ শাস্ত্রী তাঁর শতাব্দীপ্রাচীন আকরগ্রন্থ রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ–এ লিখেছেন, ‘...ইণ্ডিয়ান কংগ্রেস স্থাপিত হইলে তিনি (ব্যারিস্টার দত্ত) উৎসাহের সহিত রাজনীতির আন্দোলনে সাহায্য করিতে লাগিলেন। কংগ্রেসের অবলম্বিত আলোচ্য বিষয় সকলের মধ্যে একটা বিষয় তিনি সর্ব্বপ্রথমে অবতারণা করেন; এবং দৃঢ়তার সহিত প্রচার করেন। তাহা বিচার ও শাসন বিভাগকে স্বতন্ত্র করা।’
বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক করার রাজনৈতিক অঙ্গীকারও শত বছরের পুরোনো। ১৯২১ সালে অবিভক্ত বাংলার বিধানসভায় এ বিষয়ে প্রস্তাব গৃহীত হয়। পরবর্তী সময়ে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের ২১ দফায়, ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী দলিলে এবং ১৯৭২ সালের সংবিধানে বিচার বিভাগের পৃথক্করণ অঙ্গীকার করা হয়।
১৯৯০ সালের গণ–অভ্যুত্থানের পরও তিন জোটের রূপরেখায় এর নিশ্চয়তা দেওয়া হয়। সর্বশেষ ২০২৪ সালের গণ–অভ্যুত্থানের পর প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের প্রথম ভাষণ এবং বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের রোডম্যাপেও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও সংস্কারের দৃঢ় অঙ্গীকার ও প্রত্যয় ব্যক্ত হয়।
- ট্যাগ:
- মতামত
- স্বাধীন বিচার বিভাগ