
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে গণআকাঙ্ক্ষা পূরণ হোক
আগামী বছর অর্থাৎ ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমার্ধে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বহু প্রত্যাশিত ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী এ নির্বাচন নানা কারণেই বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। দেশবাসী এ নির্বাচনের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে এবং সর্বস্তরের ভোটার এতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করবেন বলে আশা করা হচ্ছে। বিশেষ করে যুবসমাজের মাঝে এ নির্বাচন নিয়ে উত্তেজনা বিরাজ করছে। যাদের বয়স ৩৪ বছর, তারা অন্তত তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটদান করা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। সব স্তরের ভোটাররাই ২০০৮ সালের পর থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত অনুষ্ঠিত তিনটি নির্বাচনে ভোটদান করতে পারেননি। তারা আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। পতিত স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে গণ-অসন্তোষের অন্যতম কারণ ছিল তাদের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া। ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচন ছিল ভোটারবিহীন প্রহসনের নির্বাচন।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার হবে বলে আশা করা হচ্ছে। দেশ আবারও সঠিক রাজনৈতিক ধারায় প্রবহমান হবে, এটাই সবার প্রত্যাশা। কাজেই আগামী নির্বাচন অন্য দশটি সাধারণ নির্বাচনের চেয়ে নানা কারণেই ভিন্নতর এবং গভীর তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ধারায় পরিচালিত হবে, সরকার গঠনে জনগণ তাদের মতামত প্রদান করতে পারবেন, এটাই ছিল জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে সেই গণআকাঙ্ক্ষা পূরণ হতে চলেছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থান বা রেনেসাঁ সৃষ্টি হয়েছিল এক নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যাশা নিয়ে। ধীরে ধীরে আমরা সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। আমি আশাবাদী, আগামীতে অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। এ নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশ সত্যিকারার্থে উদার গণতান্ত্রিক ধারায় প্রবহমান হবে। কোন্ রাজনৈতিক দল আগামীতে সরকার গঠন করবে, তার চেয়েও বড় বিষয় হচ্ছে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ তাদের সত্যিকার পছন্দনীয় ও গ্রহণযোগ্য প্রতিনিধি নির্বাচিত করতে পারবেন কিনা। রাষ্ট্রের মালিক হচ্ছেন জনগণ। কাজেই জনগণের মতামতের ভিত্তিতেই সংসদ সদস্য নির্বাচিত হতে হবে, যারা পরবর্তীকালে সরকার গঠন করবেন। জনগণ যাদের চাইবেন বা নির্বাচিত করবেন, তারাই দেশ পরিচালনা করবেন।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতিকে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দেওয়ার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ বলেই আমার মনে হয়েছে। তিনি বারবার দেশে-বিদেশে বিভিন্ন স্থানে আগামী নির্বাচন যথাসময়ে অনুষ্ঠানের ব্যাপারে তার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। তিনি এটাও বলেছেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে বাংলাদেশের সবচেয়ে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। তিনি আরও বলেছেন, নির্বাচনের পর তিনি কোনোভাবেই রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে থাকবেন না। তার এ মনোভাব ও অঙ্গীকারের জন্য তাকে সাধুবাদ জানাই। আমি মনে করি, প্রধান উপদেষ্টা তার এ প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবেন। নির্বাচন যাতে অবাধ ও সুষ্ঠু হয়, তার জন্য সর্বাত্মক ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।
জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন করা অনেকটাই নির্বাচন কমিশনের ওপর বর্তায়। নির্বাচন কমিশনকে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে সম্পন্ন করার জন্য সচেষ্ট থাকতে হবে। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব হচ্ছে এমন একটি নির্বাচন উপহার দেওয়া, যা জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়। নির্বাচন কমিশনকে কোনো ধরনের বিতর্কে জড়ানো চলবে না। নির্বাচন সুষ্ঠু ও জবাবদিহিমূলকভাবে অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের সামনে নানা চ্যালেঞ্জ আসবে। সেসব চ্যালেঞ্জ নিরপেক্ষভাবে মোকাবিলা করতে হবে।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন পিআর পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত হবে নাকি বিদ্যমান পদ্ধতিতে, তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে আলোচনা চলছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার গত ২৫ সেপ্টেম্বর নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেছেন, সংবিধান ও গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) পিআর নেই। বিদ্যমান সংবিধান ও আরপিও অনুযায়ী আগামী ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথমার্ধে রমজানের আগে নির্বাচনের জন্য যা যা করণীয় তা করা হচ্ছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের এ বক্তব্যের পর নির্বাচন কোন্ পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত হবে, তা নিয়ে সৃষ্ট বিতর্কের অবসান হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। যে পদ্ধতির অধীনে নির্বাচন হোক না কেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সর্বজনগ্রহণযোগ্য ও বিতর্কমুক্ত হতে হবে। যেনতেনভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠান করলে চলবে না। কোনো কোনো রাজনৈতিক দল নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্পর্কে নানা দাবি উত্থাপন করছে। এসব দাবি আলোচনার মাধ্যমে সমাধানযোগ্য বলে আমি মনে করি। রাজনৈতিক দলগুলোকে সবার আগে জাতীয় স্বার্থকে গুরুত্ব দিতে হবে। এমন কোনো কাজ করা উচিত হবে না, যা জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সৃষ্ট জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট করবে। আমরা যদি জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের চেতনা ও ঐক্য ধরে রাখতে না পারি, তাহলে পরাজিত শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। দেশ আবারও দীর্ঘদিনের জন্য স্বৈরাচারকবলিত হয়ে পড়তে পারে। নিশ্চয়ই সেটা কারও কাম্য নয়। নির্বাচন নিয়ে যে ছোটখাটো সমস্যা রয়েছে, তা অচিরেই সমাধান হয়ে যাবে বলে আমি আশাবাদী। আমাদের মনে রাখতে হবে, ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড়।