কালের কণ্ঠে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, গত রবিবার গভীর রাতে টেকনাফের গহিন অরণ্যে বিজিবি ও র্যাবের যৌথ অভিযানে ৮৪ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে। এদের মালয়েশিয়ায় পাচারের জন্য এখানে জড়ো করা হয়েছিল। এ সময় মানবপাচারকারী চক্রের তিন সদস্যকেও আটক করা হয়েছে। কালের কণ্ঠে গত শনিবার প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী টেকনাফের পাহাড়ে মানবপাচারের ঘাঁটি থেকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী ৬৬ জনকে উদ্ধার করেছে।
প্রতিনিয়ত প্রকাশিত হচ্ছে এমন খবর। সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য মতে, গত ২১ ও ২৯ আগস্ট লিবিয়ার গানফুদা ডিটেনশন সেন্টার থেকে যথাক্রমে ১৭৫ ও ১৬১ জন বাংলাদেশিকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। বছরের প্রথম সাত মাসে ফিরে এসেছিল এক হাজার ৫৪৫ জন। লিবিয়াস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস জানিয়েছে, ২০২৩ সালের জুলাই থেকে এ পর্যন্ত লিবিয়া থেকে ফেরত পাঠানো হয়েছে প্রায় পাঁচ হাজার ৭০০ জনকে।
২০১৯ সাল থেকে হিসাব করলে সংখ্যাটি ১০ হাজার ৭২৮ জনে দাঁড়ায়। তাদের অবৈধভাবে লিবিয়ায় যাওয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে ইউরোপ যাওয়া, বিশেষ করে ইতালিতে। এসব বাংলাদেশির অনেকেই ঝুঁকিপূর্ণ সমুদ্র পাড়ি দিতে গিয়ে ভূমধ্যসাগরে নৌকা ডুবে নিখোঁজ হচ্ছেন বা মারা যাচ্ছেন। প্রচুর অর্থের বিনিময়ে এই কর্মটি করে যাচ্ছে মানবপাচারকারীদের একটি শক্তিশালী আন্তর্জাতিক চক্র, যেখানে বাংলাদেশিরাও সক্রিয় সদস্য।
তথ্য মতে, ইউরোপ যাওয়ার জন্য একজন বাংলাদেশিকে ৮-১০ লাখ টাকা দিতে হয়। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) জানিয়েছে, ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত ৯ হাজার ৭৩৫ জন বাংলাদেশি ভূমধ্যসাগর দিয়ে ইতালিতে প্রবেশের চেষ্টা করে। ১৮ আগস্টের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছরের তুলনায় ইতালিতে সমুদ্রপথে অভিবাসনের সংখ্যা শতকরা ১০ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। আইওএমের পরিসংখ্যান অনুসারে, এ বছর মধ্য ভূমধ্যসাগরে ৭১৮ জন অভিবাসী হয় নিখোঁজ হয়েছেন অথবা মারা গেছেন। তাঁদের মধ্যে ৭০১ জন ডুবে গেছেন। আর ভূমধ্যসাগরে যাঁরা মারা যাচ্ছেন তাঁদের শতকরা ১২ জনই বাংলাদেশি।
গত ২ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশে নিযুক্ত ইতালির রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে বৈধ অভিবাসন, মানবপাচার প্রতিরোধ ও অভিবাসনসংক্রান্ত আইন প্রণয়ন নিয়ে আলোচনা হয়। সূত্র মতে, বর্তমানে ইতালিতে বৈধভাবে প্রায় দুই লাখ বাংলাদেশি বসবাস করছে, আর অবৈধভাবে আছে প্রায় ৭০ হাজার। অবৈধভাবে ইতালি প্রবেশের তালিকায় বাংলাদেশিরাই শীর্ষে। অবৈধভাবে অবস্থানের কারণে সম্প্রতি ৩০ হাজার বাংলাদেশির কাজের অনুমতি বাতিল করেছে দেশটির সরকার। গত মে মাসে ইতালির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মাতিও পিয়ানতেদোসিও ঢাকা সফরকালে অবৈধ অভিবাসন ও বৈধ শ্রমিক নিয়োগসংক্রান্ত বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে আলোচনা করেন। সে সময় নিয়মিত ও সুরক্ষিত অভিবাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশের সঙ্গে ইতালি একটি স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (SOP) স্বাক্ষর করে।
অবৈধ অভিবাসনের অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্র থেকেও ফেরত পাঠানো হচ্ছে বাংলাদেশসহ অনেক দেশের নাগরিকদের। গত ২ আগস্ট মার্কিন সামরিক উড়োজাহাজে একজন নারীসহ ৩৯ জন বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠানো হয়। ঈদুল আজহার আগেও একদল বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠানো হয়েছিল। মালয়েশিয়ায় অবৈধভাবে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের ক্ষেত্রেও একই চিত্র দেখা যায়। এমনকি মালয়েশিয়ার বিমানবন্দর থেকে সঠিক কাগজপত্র না দেখাতে পারায় অনেক বাংলাদেশিকেই ফেরত পাঠানোর ঘটনা ঘটছে। একসময় কক্সবাজার থেকে থাইল্যান্ড হয়ে মালয়েশিয়ায় মানবপাচার করে প্রতিবছর সংগ্রহ করা হতো প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলার। এমনও ঘটেছে যে পাচারকারীরা অর্থ আদায়ে ব্যর্থ হয়ে শত শত ব্যক্তিকে সমুদ্রে ফেলে দিয়েছে। মালয়েশিয়ায় পৌঁছানোর উদ্দেশ্যে থাইল্যান্ডের জঙ্গলের বিভিন্ন ক্যাম্পে হাজার হাজার বাংলাদেশির আশ্রয় হয়েছিল। আবার অনেকেরই ঠাঁই হয়েছিল থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার গণকবরে। ইউএনএইচসিআরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৫ সালের প্রথম তিন মাসে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ২৫ হাজার মানুষ মানবপাচারের শিকার হয়েছিল।
যেসব কারণে মানুষ পাচারকারীর খপ্পরে পড়ে তার মধ্যে দরিদ্রতা, কর্মসংস্থানের অভাব, আয়বৈষম্য, সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা, পাচার রোধে প্রয়োজনীয় আইনের প্রয়োগ না থাকা এবং সচেতনতার অভাব উল্লেখযোগ্য। মানবপাচারকারীরা বিদেশে ভালো চাকরির লোভ দেখিয়ে অরক্ষিত মানুষগুলোকে লোভের জালে ফেলে। অনেকে আবার উন্নত জীবনের আশায় স্বেচ্ছায় পাচারকারীদের কাছে যায়, চাহিদা অনুযায়ী অর্থ প্রদানেও দ্বিধা করে না। মানবপাচার রোধ করতে সরকার, সুধীসমাজ, বেসরকারি খাত এবং অন্যান্য পাচারবিরোধী ব্যক্তি বা সংস্থার মধ্যে একটি টেকসই সহযোগিতা স্থাপন করা অত্যন্ত জরুরি। মানবপাচারের দৃশ্যমান প্রবণতার মূল কারণগুলো নিয়ে কাজ করার জন্য একটি সমন্বিত পাচারবিরোধী কৌশল প্রণয়ন করা আবশ্যক।