ন্যায়বিচার একটি রাষ্ট্রের প্রাণ, সভ্যতার ভিত্তি এবং জনগণের মৌলিক নিরাপত্তার প্রতীক। ন্যায়বিচার না থাকলে রাষ্ট্র কেবল একটি শক্তিশালী প্রশাসনিক যন্ত্রে পরিণত হয়, যেখানে মানুষের মর্যাদা, অধিকার ও স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে যায়। তাই ইতিহাসের প্রতিটি ধাপে দেখা গেছে যে রাষ্ট্র তখনই টেকসই, সমৃদ্ধ ও উন্নত হয়েছে যখন সেখানে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু ন্যায়বিচার আসলে কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়, কেন এর প্রয়োজন, উন্নত রাষ্ট্রে কীভাবে এটি বাস্তবায়িত হয় এবং উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোয় কেন এটি ব্যাহত হয়- এসব প্রশ্নই আমাদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়।
ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মূল শর্ত হলো শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ আইনপ্রণয়ন ও আইন প্রয়োগ ব্যবস্থা। কোনো রাষ্ট্রে সংবিধান ও আইন যদি প্রত্যেক নাগরিকের সমান অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত না করে, তবে সেখানে প্রকৃত ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয় না। বিচার বিভাগকে হতে হবে সম্পূর্ণ স্বাধীন ও নিরপেক্ষ, প্রশাসনকে হতে হবে জবাবদিহিমূলক, আর আইন প্রণয়নকারী ও প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর হতে হবে ন্যায্য, নির্দলীয় ও জনগণের সেবক।
রাজনৈতিক প্রভাব বা অর্থের প্রলোভন যখন আদালত, পুলিশ বা আমলাতন্ত্রে ঢুকে পড়ে, তখন ন্যায়বিচার ভঙ্গুর হয়ে যায়। তবে এসবের পাশাপাশি জনগণের মধ্যেও সচেতনতা ও নৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তোলা জরুরি। কারণ ন্যায়বিচার শুধু আদালতের কাঠগড়ায় নয়, সামাজিক সম্পর্কেও প্রতিফলিত হয়। সমাজে ক্রমাগত বিশৃঙ্খলা কোনোভাবেই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার উপযোগী হয় না। এমনকি নিয়োগে যোগ্যতার পরিবর্তে পক্ষপাতিত্ব, ব্যবসায় মুনাফার নামে প্রতারণা, কিংবা লিঙ্গ-বৈষম্যের কারণে নারীর অধিকার খর্ব হওয়া-এসব কিছুই ন্যায়বিচারের পরিপন্থী।
ন্যায়বিচারের প্রয়োজন কেন? এর উত্তর স্পষ্ট। ন্যায়বিচার মানুষের মৌলিক অধিকার ও মর্যাদাকে সুরক্ষা দেয়, দুর্বলকে শক্তির সামনে সমান করে তোলে, শোষিতকে মুক্তি দেয় এবং সমাজে শান্তি ও স্থিতি নিশ্চিত করে। অন্যদিকে ন্যায়বিচারহীন রাষ্ট্রে জন্ম নেয় অবিশ্বাস, হতাশা ও বৈষম্য। তখন মানুষ আইন হাতে তুলে নেয়, সংঘাত ছড়িয়ে পড়ে, আর অবশেষে রাষ্ট্র অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, অন্যায়ের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা কোনো রাষ্ট্র বা সাম্রাজ্য দীর্ঘদিন টেকেনি। তাই ন্যায়বিচার শুধু একটি নৈতিক আদর্শ নয় বরং রাষ্ট্র টিকে থাকার জন্য অপরিহার্য শর্ত। ইতিহাসবিদরা বলেন, রোমান সাম্রাজ্যের পতনের অন্যতম কারণ ছিল শাসকদের অন্যায় শাসন, প্রশাসনে দুর্নীতি এবং নাগরিকদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ। ন্যায়বিচারের অভাব মানুষকে রাষ্ট্র থেকে বিমুখ করে তোলে এবং অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ ও সংঘাতকে উসকে দেয়। ফলে শক্তিশালী সাম্রাজ্য ধ্বসে পড়ে।