রক্ত ও অশ্রুমাখা ক্রিসমাসের দেশে ভালবাসার ফুল
এবারের বড়দিনে টিআরটি ওয়ার্ল্ড চ্যানেলের এক বৈঠকে সঞ্চালক এনডা ব্র্যাডির দেওয়া ‘হ্যাপি ক্রিসমাস’ সম্ভাষণের উত্তরে ফিলিস্তিনি যাজক মুনথার আইজ্যাক সঞ্চালককে এবং তার মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে বড়দিনের শুভেচ্ছা জানালেন। তিনি বলেন, “ক্রিসমাসের দেশ ফিলিস্তিন থেকে আপনাদের জানাই শুভ বড়দিন।”
রেভারেন্ড আইজ্যাক বর্তমানে ইসরায়েল অধিকৃত পশ্চিম তীরের রামাল্লায় একটি চার্চের যাজক হিসেবে দায়িত্বরত আছেন। দুই বছর আগে তিনি ছিলেন বেথলেহেমের ইভানজেলিক্যাল লুথেরান ক্রিসমাস চার্চের যাজক। সেই সময়, অর্থাৎ ২০২৩ সালের ২৩ ডিসেম্বর, তিনি চার্চের এক সভায় একটি ভাষণ দিয়েছিলেন যার শিরোনাম ছিল: ‘ক্রাইস্ট আন্ডার দ্য রাবল’ (ধ্বংসস্তূপের নিচে যিশু)। সেখানে তিনি স্পষ্টভাবে বলেছিলেন, “আজ যদি যিশুর জন্ম হতো, তবে তার জন্ম হতো গাজার ধ্বংসস্তূপের নিচে।” পরে এই বক্তব্যের প্রেক্ষাপটেই তার বিখ্যাত বই ‘ক্রাইস্ট ইন দ্য রাবল: ফেইথ, দ্য বাইবেল অ্যান্ড দ্য জেনোসাইড’ প্রকাশিত হয়।
ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরের এই বেথলেহেমেই জন্মেছিলেন যিশু খ্রিস্ট। সেই থেকে এটি একটি পবিত্র স্থান হিসেবে বিবেচিত এবং এখানে তার জন্মদিন পালিত হয় অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে। কেননা, তিনি সেই মহামানব, যিনি দ্বিধাহীনভাবে ধর্ম-বর্ণ-জাতি নির্বিশেষে সকল মানুষের সাম্য ঘোষণা করেছিলেন। তিনি প্রচার করেছিলেন যে, ভালোবাসাই হলো মানবতার কেন্দ্রবিন্দু। ন্যায় ও অন্যায়ের সীমারেখা তিনি নির্ধারণ করেছিলেন সাধারণ মানুষের জন্য সবচেয়ে সহজবোধ্য উপায়ে। তৎকালীন ইহুদি শাসকগোষ্ঠী তার চিন্তা ও কর্মকে দমন করতে তাঁকে ক্রুশবিদ্ধ করে। কিন্তু এরপর যিশু হয়ে ওঠেন আরও অপ্রতিরোধ্য, অপরাজেয় ও বৈশ্বিক—তলোয়ার দিয়ে নয়, বরং সাম্য, প্রেম ও মানবতার আদর্শ দিয়ে।
বেথলেহেমে মুসলমান ও খ্রিস্টানরা মিলে অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণভাবে যিশু খ্রিস্টের জন্মদিন উদযাপন করে থাকে। যদিও এই স্থানটি ফিলিস্তিন মুক্তি সংস্থার (পিএলও) অধীনে একটি স্বায়ত্তশাসিত এলাকা, কিন্তু বাস্তবে এর সবকিছুই ইসরায়েলের কঠোর নিয়ন্ত্রণে। ২০২৩ সালে গাজায় গণহত্যা শুরু হওয়ার পর থেকে ইসরায়েল এখানেও বিনা উসকানিতে নির্বিচারে মানুষ হত্যা করে চলেছে; যার ফলে এ পর্যন্ত অন্তত এক হাজার ফিলিস্তিনির মৃত্যু হয়েছে। ইসরায়েলি এই গণহত্যার শিকার ফিলিস্তিনের মুসলিম ও খ্রিস্টান উভয় জনগোষ্ঠি। এই নৃশংসতার প্রতিবাদে গত দুই বছর বেথলেহেমে বড়দিনের সব ধরনের উৎসব পালন বন্ধ ছিল। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর সাম্প্রতিক সাময়িক যুদ্ধবিরতি চুক্তির ফলে পরিস্থিতির যেটুকু উন্নতি হয়েছে, তার মাঝেই এবারের আনন্দোৎসবের আয়োজন করা হয়েছে—যা স্বাভাবিকভাবেই এক গভীর দুঃখ ও সুখের সংমিশ্রণ।
যিশু খ্রিস্টানদের কাছে ত্রাতা বা ঈশ্বরপুত্র হলেও, মুসলমানদের কাছেও ঈসা (আ.) নামে গুরুত্বপূর্ণ একজন নবীর মর্যাদা পেয়ে থাকেন। যিশু ও মাতা মেরি (মুসলমানদের কাছে যিনি মরিয়ম)—উভয়ই দুই ধর্মীয় সম্প্রদায়ের কাছে অত্যন্ত সম্মানীয়। তাছাড়া, বেথলেহেমের বড়দিনের উৎসব স্থানীয় বাসিন্দাদের আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস। বিদেশি পর্যটকদের যাতায়াত, হোটেল ভাড়া, খাবারদাবার ও শৌখিন জিনিসের কেনাবেচা এখানকার অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। গত দুই বছরে এখানকার অনেক হোটেল, দোকানপাট ও ব্যবসা-বাণিজ্য পুরোপুরি বন্ধ ছিল। ফলে ট্যাক্সিচালক, ট্যুর গাইড এবং বিক্রয়কর্মীসহ বহু মানুষ বেকার হয়ে পড়ায় সেখানকার অর্থনৈতিক জীবন চরমভাবে পর্যুদস্ত হয়েছে। এবারের বড়দিন তাদের জন্য নতুন করে খানিকটা আশার আলো জ্বালিয়েছে, যদিও পর্যটকদের উপস্থিতি স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় অনেক কম ছিল। বেথলেহেমে বসবাসরত মুসলমান ও খ্রিস্টানসহ সব ধর্মের মানুষই এই অভিন্ন দুঃখ-কষ্ট এবং আনন্দের সমান অংশীদার।
বেথলেহেমের মেয়র মাহার নিকোলা ক্যানাওয়াতি বড়দিন উপলক্ষে ভ্যাটিকান রেডিওতে দেওয়া তার বার্তায় বিশ্ববাসীকে এখানে আসার আহ্বান জানিয়েছেন; তিনি আশ্বস্ত করেছেন যে শহরটি এখন নিরাপদ। এখানকার ৮০ শতাংশ মানুষের আয় সরাসরি পর্যটনের ওপর নির্ভরশীল। গাজায় চলমান দুর্বিষহ পরিস্থিতির মাঝে এবারও বড়দিনের অনুষ্ঠান করা নিয়ে তাঁদের মনে যথেষ্ট দ্বিধা ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে তাঁরা উপলব্ধি করেন যে, মানবতার জন্য আশার আলো এখান থেকেই জ্বলা উচিত।
তিনি বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন যে, এই উৎসব সমস্ত ফিলিস্তিনিদের, কেবল খ্রিস্টানদের নয়। তিনি আরও বলেন, “আমরা একই জাতি—খ্রিস্টান, মুসলমান ও সামারিতান। আমরা একে অপরের জন্য। আমরা শান্তি ভালোবাসি। আমরা আমাদের দেশে ন্যায়বিচার ও দীর্ঘস্থায়ী শান্তি চাই।”
মেয়র হওয়ার পর তিনি পোপকে চিঠি লেখেন এবং পরে সাক্ষাতে গাজায় যা হচ্ছে তা বন্ধে পোপের হস্তক্ষেপ আশা করেন। ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষের প্রদত্ত নিয়ম অনুযায়ী বেথলেহেমের মেয়র হতে হবে কেবল খ্রিস্টানদের মধ্য থেকে। তারপরও সেখানে খ্রিস্টান জনসংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাচ্ছে যারা কিনা পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো খ্রিস্টান সম্প্রদায়। ইসরায়েলি দখলদারিত্ব, কঠোর নিয়ন্ত্রণ, আক্রমণ ইত্যাদি কারণে সেখানকার উচ্চশিক্ষিত খ্রিস্টানরা ইউরোপ, আমেরিকা ও কানাডায় চলে যাচ্ছে। গেল বছরে চলে গেছে এক হাজারের বেশি খ্রিস্টান। তিনি পোপকে বলেন, “পবিত্র ভূমিতে ফিলিস্তিনি খ্রিস্টানের সংখ্যা এখন মাত্র ১ লাখ ৬৮ হ্জার জন। যেখানে কিনা সারা বিশ্বে ৪০ লাখ ফিলিস্তিনি খ্রিস্টান বাস করে। এটাই প্রমাণ করে এখানকার খ্রিস্টানরা কী পরিমাণ কষ্টের মধ্যে বেঁচে আছে।”