পাহাড় কর্তন ও পরিবেশ বিপর্যয় রোধে প্রয়োজন সম্মিলিত উদ্যোগ
পাহাড়-পর্বত প্রকৃতি ও পরিবেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক সম্পদ। এটি পরিবেশ, অর্থনীতি ও মানবজীবনের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। পৃথিবীর জীববৈচিত্র্য ও বিশুদ্ধ পানির উৎস ধরা হয় পাহাড় ও পর্বতকে। পৃথিবী পৃষ্ঠের প্রায় ২৭ শতাংশে রয়েছে পাহাড় ও পর্বতমালা, যেখানে বসবাস করছে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৫ শতাংশ মানুষ। গাছপালা ও প্রাণীদের আশ্রয়স্থল হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা এ পাহাড়গুলো জনসংখ্যার চাপ, নগরায়ণ ও শিল্পায়নের কারণে বিপর্যয়ের সম্মুখীন। শহরাঞ্চলের অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও শিল্পায়নের কারণে এসব পাহাড়কে নির্বিচারে কাটা হচ্ছে, এতে বিনষ্ট হচ্ছে প্রকৃতির ভারসাম্য। পাহাড় কাটার ফলে বর্ষা মৌসুমে (জুন-আগস্ট) পাহাড়ধস এ অঞ্চলের অন্যতম একটি সমস্যা। পাহাড় কাটার মাটি দিয়ে বিভিন্ন নিম্নভূমি ভরাট, জমি ভরাট, ইটের ভাটা, সড়ক যোগাযোগ নির্মাণসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহার করা হয়, যা বিনষ্ট করছে প্রকৃতির স্বাভাবিক ভারসাম্য এবং ত্বরান্বিত করছে পরিবেশ বিপর্যয়। পাহাড় কাটার ফলে পাহাড়ি ভূমির ঢাল বৃদ্ধি পায়, মাটির বুনট হ্রাস পায়, গাছপালা মারা যায় এবং বৃষ্টির পানি মাটির গভীরে দ্রুত অনুপ্রবেশ করে। যেসব পাহাড় খাড়াভাবে কাটা হয় সেসব পাহাড়ে ধসের ঝুঁকির মাত্রাও বেশি থাকে। সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রাম ও দক্ষিণ চট্টগ্রামে পাহাড় কাটা ও পাহাড়ধসজনিত হতাহতের সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের টেকসই উন্নয়নের জন্য হুমকিস্বরূপ।
বাংলাদেশ তথা চট্টগ্রামের পাহাড় কর্তনের ইতিহাস নিয়ে স্বীকৃত কোনো গবেষণা এখনো অনুপস্থিত। পূর্ববর্তী কিছু বিচ্ছিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, ১৭৬০ সালে প্রথম চট্টগ্রামে আবাসিক এলাকা করার জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পাহাড় কেটে জঙ্গল পরিষ্কার করে। ১৯৫০ সালে নগরের ষোলশহর, নাসিরাবাদ, পাহাড়তলী ও ফৌজদারহাট এলাকায় শিল্প এলাকা স্থাপনের জন্য বৃহৎ পরিসরে আরো কিছু পাহাড় কর্তন করা হয়। বাংলাদেশে, বিশেষ করে চট্টগ্রাম শহর ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় ষাট দশকে ছোট-বড় প্রায় ২০০টি পাহাড় ছিল। ১৯৬১ সালের মাস্টারপ্ল্যানে চট্টগ্রামকে চারটি জোনে ভাগ করে নতুন বসতি স্থাপনের জন্য কিছু পাহাড় কর্তনের সুপারিশ করা হয়। এরপর থেকেই মূলত ধীরে ধীরে পাহাড় কেটে বসতি ও শিল্প-কারখানা স্থাপন বৃদ্ধি পেতে থাকে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বনবিদ্যা ইনস্টিটিউটের এক গবেষণায় দেখা যায়, ১৯৭৬ সালে শহরের পাঁচ থানায় (খুলশী, পাহাড়তলী, বায়েজীদ, পাঁচলাইশ ও কোতোয়ালি) পাহাড় ছিল ৩২ দশমিক ৩৭ বর্গকিলোমিটার, কিন্ত ২০০৮ সালে হ্রাস পেয়ে দাঁড়ায় ১৪ দশমিক শূন্য ২ বর্গকিমি অর্থাৎ পাহাড় কাটা হয় ১৮ দশমিক ৩৪৪ বর্গকিমি। স্বাধীনতার পর থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ৪০ বছরে চট্টগ্রামে বিলুপ্ত হয়েছে প্রায় ৯০টি পাহাড়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের ছাত্র মহিব বিল্লাহ ও আমার এক যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৮৯ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত এই এক যুগ (১২ বছর) শুধু খুলশী ও নাসিরাবাদ এলাকায় পাহাড় কমেছে ৫ দশমিক ২৩ শতাংশ। এর মধ্যে ২ দশমিক ৬২ শতাংশ এলাকায় নির্মিত হয়েছে ঘরবাড়ি, অবশিষ্ট ২ দশমিক ৬১ শতাংশ এলাকায় বিভিন্ন শিল্প-প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন ছোট-বড় দোকান ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের অন্য একটি গবেষণায় দেখা গেছে, মূলত আবাসিক প্লট ভরাট ও উন্নয়ন, নিম্নভূমি ও জলাশয় ভরাট, সড়ক সম্প্রসারণ ও সংস্কার, ইটভাটা সড়ক নির্মাণ ইত্যাদি কাজে পাহাড় কাটার মাটি বেশি ব্যবহার করা হয়। ওই গবেষণায় আরো দেখা যায়, পাহাড় কাটার কারণে প্রাণীবৈচিত্র্যের অবনতি, বন উজাড়, ভূমিক্ষয়, নান্দনিক সৌন্দর্যের অবনতি, জলাবদ্ধতা, হতাহতজনিত ক্ষয়ক্ষতি ইত্যাদির মাধ্যমে নগর পরিবেশের সামগ্রিক অবনতি হচ্ছে।
চট্টগ্রাম মহানগরীর পাহাড়গুলো মূলত বিভিন্ন সরকারি সংস্থা, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি সংস্থা এবং চট্টগ্রাম শহরের বৃহৎ শিল্প গ্রুপের মালিকানাধীন। সরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বাংলাদেশ রেলওয়ের পাহাড়ের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি, এরপর সিটি করপোরেশন, সিডিএ, ওয়াসা এবং পাবলিক ওয়ার্ক বিভাগের মালিকানার পাহাড়গুলো। অন্যদিকে বৃহৎ শিল্প গ্রুপের মালিকানাধীন পাহাড়গুলো হলো: এ কে খান, ইস্পাহানি, ফিনলে ইত্যাদি। পাহাড় কাটার মাটি নিয়ে গত ১৫ বছরে বৃহৎ পর্যায়ের ব্যবসা গড়ে উঠেছে। পাহাড় কাটার মাটি দিয়ে শহরের বিভিন্ন জলাশয় ভরাট, জমি ভরাট করে আবাসন প্রকল্প তৈরি, ইটের ভাটা, সড়ক যোগাযোগ নির্মাণসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহার হয়। বিগত কয়েক দশকে চট্টগ্রামের সরকারি, বেসরকারি ও ব্যক্তিগত মালিকানাধীন পাহাড়গুলো ব্যাপক আকারে এবং অবৈধভাবে কাটা হয়েছে। আবাসিক, ইটভাটা, শিল্প-কারখানা ও পুকুর ভরাটের জন্য মাটি বিক্রির জন্য মূলত চট্টগ্রামের পাহাড় কাটা হয়েছে। ফলে জীববৈচিত্র্য হ্রাস, মাটির ক্ষয়, নদী-নালা-খাল ভরাট এবং জলাবদ্ধতা এবং প্রাকৃতিক সম্পদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়। চট্টগ্রামে পাহাড় কাটার জন্য মূলত বিভিন্ন আবাসন প্রকল্প দায়ী। শহরে আগত মানুষের আবাসনের চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বৈধ-অবৈধভাবে পরিকল্পিত ও অপরিকল্পিত উপায়ে বসতি নির্মাণ করছে। অনেকে অবৈধভাবে পাহাড় কেটে এর পাদদেশে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য বস্তি গড়ে তোলে, আবার অনেক পাহাড় কেটে সরকারি স্থাপনা তৈরি করা হয়, আবার কিছু পাহাড় কেটে উচ্চবিত্তের আবাসন প্রকল্প করে উচ্চমূল্যে বিক্রি করা হয়। আবাসন প্রকল্প লাভজনক বলে পরিবেশের ভারসাম্য এবং পাহাড়ধসজনিত দুর্যোগ ঝুঁকির ভাবনা বিবেচনা না করেই একটি চক্র এখনো চট্টগ্রামে নিয়মিত পাহাড় কেটে চলেছে। পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম ২০১৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত বন্দরনগরীতে ৫৩টি জায়গায় পাহাড় কাটার চিহ্ন পেয়েছে, এর মধ্যে ২৫টি স্থানে পাহাড় কাটা হয় ২০১৯ সালে। এছাড়া চট্টগ্রাম শহরের খুলশী, বাংলাবাজার, শাপলা আবাসিক, নাসিরাবাদ, মতিঝর্ণা, চন্দ্রনগরসহ অন্তত ১৫-২০টি স্থানে পাহাড় কাটা চলছে, যা মাঠ পর্যায়ের গবেষণায় জানা যায়। পাহাড় কাটার জায়গাগুলো এখন পাহাড়ধসের ঝুঁকিতে রয়েছে। পাহাড় কাটার কারণে নিঃশেষ হচ্ছে বনভূমি, বন্যপ্রাণীর আবাস। এছাড়া পাহাড় কাটা মাটি দ্বারা নালা-নর্দমা-খাল ভরাট হয়ে বর্ষা মৌসুমে নগরে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়।
গত কয়েক বছর আগে সিডিএ পাহাড় কেটে বায়েজিদ হয়ে ফৌজদারহাট পর্যন্ত ছয় কিমি সংযোগ সড়ক নির্মাণ করে। পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম রাষ্ট্রীয় জরুরি প্রয়োজনের কথা বিবেচনা করে সিডিএকে বেশকিছু শর্ত সাপেক্ষে আড়াই লাখ ঘনমিটার পাহাড় কাটার অনুমতি দেয়, কিন্তু প্রকল্প এলাকায় ১৬টি পাহাড়ের বিভিন্ন অংশ থেকে কাটা হয় প্রায় সাড়ে ১০ লাখ ঘনমিটার পাহাড়। এ পাহাড় কাটার দায়ে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম সিডিএ’কে ১০ কোটি ৩৮ লাখ ২৯ হাজার ৫৫৩ টাকা জরিমানা করে ২০২০ সালের ২৯ জানুয়ারি। পরবর্তী সময়ে এ সড়কের পাশ ধরে ব্যাপক আকারে পাহাড় কাটা শুরু হয়। এ সড়কে এখন পর্যন্ত পাহাড় কেটে ৪০০-৫০০টি ঘর তৈরি করা হয়েছে। মূলত করোনা কালীন সাধারণ ছুটির (এপ্রিল-মে) মাসে পাহাড় কেটে এসব ঘর তৈরি করা হয়। পরবর্তী সময়ে ২০২০ সালের ২৪ জুন পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জেলা প্রশাসন, পরিবেশ অধিদপ্তর ও রেলওয়ে যৌথ অভিযান চালিয়ে ১৬টি পাহাড় কেটে গড়ে তোলা ৩৫০টি অবৈধ ঘর ও স্থাপনা উচ্ছেদ করে। মার্চ ২০২০ সালে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র না নিয়ে পাঁচ কিমি পাহাড় কেটে রাস্তা তৈরি করায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও দুই ব্যবসায়ীকে বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫-এ ধারা ৭ অনুযায়ী ১২ লাখ ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। সরকারি অনুমতি ছাড়া পাহাড় কাটা পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-১৯৯৫ (সংশোধিত-২০১০) অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ। পাহাড়ি এলাকায় সরকারি বা অনুমোদন প্রাপ্ত সংস্থা কর্তৃক অবকাঠামোগত উন্নয়নের ফলে অনেক সময় পাহাড় কাটতে হয়, এ রকম পরিকল্পনা সতর্কতার সঙ্গে গ্রহণ না করলে এসব স্থান হতে পাহাড়ধসজনিত ক্ষয়ক্ষতি ও হতাহতের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে পারে। সম্প্রতি চট্টগ্রামের বারৈয়ারহাট থেকে রামগড় পর্যন্ত সড়ক প্রশস্তকরণ প্রকল্পে সরকারি অনুমোদন ছাড়া ১ লাল ৩২ হাজার ঘনফুট পাহাড় কাটার দায়ে প্রকল্প কর্তৃপক্ষকে কোটি ৩২ লাখ ৫৭ হাজার টাকা জরিমানা করে পরিবেশ অধিদপ্তর। তবে পাহাড় কাটার দায়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা কোনো ধরনের টেকসই সমাধান হতে পারে না। কারণ যত টাকাই জরিমানা ধার্য করা হোক কর্তিত পাহাড়ের পরিবেশ ও প্রতিবেশ পুনরুদ্ধার অসম্ভব।