পশ্চিমবঙ্গে একটা আঞ্চলিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের উত্থান হচ্ছিল। কিন্তু ধীরে। হঠাৎই সেটা সুনামিতে পরিবর্তিত হলো গত কয়েক মাসে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক অপেক্ষাকৃতভাবে খারাপ হওয়ার পর, ভারতে একটা প্রচার শুরু হলো যে বাংলাভাষী মানুষের অনেকেই আসলে বাংলাদেশ থেকে এসেছেন। এই প্রচারণার ফলে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে বাঙালিদের গ্রেপ্তার বা হেনস্তা করা হচ্ছে।
যাঁরা হেনস্তার শিকার হলেন, তাঁদের বড় অংশ বাঙালি মুসলমান। একটা অংশ হিন্দুও বটে। প্রধানত যাঁরা খেটে খান, ইংরেজিতে যাঁদের বলা হয় ‘ওয়ার্কিং ক্লাস’, মূলত পরিযায়ী শ্রমিক। দু–একজন মধ্যবিত্তও বিপদে পড়লেন। বাঙালির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে—এই ভয় ও আবেগ ছড়িয়ে পড়ল। মিটিং, মিছিল, গান-কবিতা, সভা-সমিতি, যা এখনো বাঙালির প্রধান অস্ত্র—সেসব শুরু হলো। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে রাস্তায় সারাক্ষণই শোনা যাচ্ছে মোহিনী চৌধুরীর ‘মুক্তির মন্দির সোপানতলে’ থেকে প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের ‘আমি বাংলায় গান গাই’। আবেগ গণ-আন্দোলনে পরিণত হচ্ছে।
এতে কার লাভ
এ নিয়ে কোনো সন্দেহই নেই যে এই নতুন বাঙালি বা আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদ রাজনৈতিকভাবে ২০২৬ সালের পশ্চিমবঙ্গ নির্বাচনে একটাই দলকে সাহায্য করবে। তৃণমূল কংগ্রেস। গত ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকার ফলে তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে যে ‘অ্যান্টি ইনকামবেন্সি’ বা দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার ফলে যে স্বাভাবিক বিরোধিতার হাওয়া তৈরি হয়েছে, সেটাকে অনেকটাই স্তিমিত করছে এই নব্য বাঙালি জাতীয়তাবাদ।
দ্বিতীয়ত, বিজেপি যখন পশ্চিমবঙ্গে তাদের উত্তর ভারতের ফর্মুলা প্রয়োগ করে হিন্দু বনাম মুসলমানের ‘বাইনারি’ তৈরি করে ভোট টানতে চাইছে, তখন তৃণমূল চাইছে ‘বাঙালি বনাম অবাঙালি–বহিরাগত’র বাইনারি তৈরি করতে। এই বাইনারি অন্তত দুটি নির্বাচনে, ২০২১–এর বিধানসভা এবং ২০২৪–এর লোকসভায় তৃণমূলকে সাহায্য করেছে। কিন্তু তখনো ভারতের অন্য প্রান্তে বাঙালিদের বহিষ্কারের এই পরিস্থিতি তৈরি হয়নি।
এবার সেটা তৈরি করল বিজেপি। অনুপ্রবেশকারী ধরা হচ্ছে বলে পশ্চিমবঙ্গের বাংলাভাষীদের ‘বাংলাদেশি’ তকমা দিয়ে রাজ্যে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। সম্প্রতি আরএসএসের এক নেতাকে বলছিলাম, এর ফলে বিজেপিরই তো ক্ষতি হচ্ছে। তিনি মানলেন না। বললেন, বেআইনি অনুপ্রবেশকারী চিহ্নিত করার প্রয়োজন আছে। ভালো কথা। প্রায় ১০ বছর ধরে বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে গড়ে ৩৫-৪০ শতাংশ হারে ভোট পাচ্ছে, গত বিধানসভা নির্বাচনে পেয়েছে রেকর্ড ৭৭টি আসন। বাঙালি ‘আইডেন্টিটি’কেন্দ্রিক যে আবেগ তৈরি হয়েছে, তাতে বিজেপি এই হার ও আসন ধরে রাখতে পারলে অবাক হতে হবে।
অন্যদিকে ভয়ের বিষয় হলো, দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকার সুবাদে তৃণমূলের নিপীড়ন চরমে পৌঁছেছে। এবারও তারা যদি এককভাবে ক্ষমতায় আসে, তবে নিপীড়নের মাত্রা বাড়বে। সেটিও আশঙ্কার কারণ।