‘লিখিত সংবিধান’, ‘সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা’—এসব বিষয়ে তর্কবির্তকের শুরু দুটি বিপ্লবোত্তর সংবিধান থেকে। প্রথমটি ১৭৮৯ সালের যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান আর দ্বিতীয়টি ফরাসি বিপ্লবোত্তর গাঠনিক ক্ষমতা থেকে উদ্ভূত ১৭৯১ সালের সংবিধান।
১৭৯১ সালে ফরাসি সংবিধানটি ১৭৯৩ সালে বাতিল হয়ে গেলেও মার্কিনটি ২৩৬ বছর পরও বহাল আছে। এটির দুই পুরোধা টমাস জেফারসন আর জেমস ম্যাডিসন যুক্তরাষ্ট্রের যথাক্রমে তৃতীয় ও চতুর্থ রাষ্ট্রপ্রধানও ছিলেন এবং তাঁদের যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম স্থপতি বলে গণ্য করা হয়।
সাংবিধানিকতা ধারণার সমর্থক জেফারসন সংবিধান নিয়ে ম্যাডিসনকে লেখা এক বিখ্যাত চিঠিতে বলেছেন, ‘...কোনো সমাজই একটি চিরস্থায়ী সংবিধান অথবা আইন তৈরি করতে পারে না। পৃথিবী সব সময়ই জীবিত প্রজন্মের অধীন। তারাই তাদের মতো করে দুনিয়াটাকে পরিচালনা করতে পারে।’
‘...প্রকৃতির নিয়মে পূর্বসূরিদের দেওয়া সংবিধান আর আইনকানুন তাদের সঙ্গে সঙ্গে কবরে চলে যায়। প্রকৃতি তাদের জীবৎকাল পর্যন্তই তাদের রক্ষা করতে পারে। প্রতিটি সংবিধান আর সব আইনের স্বাভাবিক গড় আয়ু ১৯ বছর, তার বেশি নয় কিছুতেই। এর বেশি চালু রাখলে সেটা হবে কেবলই জোরজবরদস্তি।’
১৯ বছর অবশ্য একটা আন্দাজমাত্র নয়। বেশ হিসাব করেই এটা বের করেছিলেন। আশ্চর্য হলো, ২২০ বছর পর এসে সেই দেশেরই গবেষক টম গিন্সবার্গের এক গবেষণায় (এনডিওরেন্স অব ন্যাশনাল কনস্টিটিউশন, ২০০৯) দেখা গেছে, দুনিয়ার সব সংবিধানের গড় আয়ুই আসলে ১৯ বছর!
যেকোনো নতুন সংবিধানে সিংহভাগই থাকে পুরোনো উপাদান। কারণ, আধুনিক রাষ্ট্রকাঠামো, জন-অভিপ্রায় প্রকাশের ধরন, সরকারব্যবস্থা ও পরিচালনাপদ্ধতি, অধিকার ও দায়িত্ব, বিরোধ মীমাংসা, রাজনৈতিক সংগঠন ও জবাবদিহি বাস্তবায়নের পদ্ধতির ধরনে খুব বেশি পার্থক্য হয় না।
রাষ্ট্রগঠনের এসব পদ্ধতি বা তরিকা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষাও কমবেশি হয়েছে। তাই সংবিধান পুনর্লিখন বা নতুন সংবিধান প্রশ্নে নেতিবাচক বিষয়গুলোর সঙ্গে ইতিবাচক বিষয়গুলোও ধুয়েমুছে যাওয়ার অনেকের যে আশঙ্কা, সেটাকে অমূলক বলেই মনে হয়। গত ৫৪ বছরে আমাদের সংবিধানই চারবার ‘পুনর্লিখিত’ হয়েছে চতুর্থ, পঞ্চম, দ্বাদশ ও পঞ্চদশ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে।
২.
বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি যে নাগরিকদের কাছে অনেকাংশেই বিশ্বাসযোগ্য ও ন্যায়সংগত নয়, সেটা কি শুধু শাসক (সরকার) বা জনগণেরই ‘দোষ’, নাকি রাষ্ট্রব্যবস্থায় কোনো গোলযোগ আছে—এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজাটা এখন জরুরি।
আমাদের সংবিধানের ৭(২) অনুচ্ছেদে লেখা আছে, ‘জনগণের অভিপ্রায়ের পরম অভিব্যক্তিরূপে এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন...।’ অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রে সংবিধান সর্বোচ্চ আইন নয়! উদাহরণ দিলে বিষয়টা স্পষ্ট হবে।
সংবিধানের ২৭ ও ২৮(২) অনুচ্ছেদের সারকথা হলো: সব নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী এবং রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী পুরুষের সমান অধিকার লাভ করবেন।
সংবিধান ও মৌলিক অধিকারের সঙ্গে অসামঞ্জস্য কোনো আইন করা যাবে না, করলে অসামঞ্জস্যপূর্ণ অংশ বাতিল হবে; সবাই আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী; রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী পুরুষের সমান অধিকার লাভ করবেন।
কিন্তু বাস্তবতা হলো বাংলাদেশে মুসলিম, হিন্দুসহ অন্য ধর্মাবলম্বী ও জাতিগোষ্ঠীগুলো পৃথক উত্তরাধিকার আইন মেনে চলে। বিবাহ, বিচ্ছেদ, অভিভাবকত্বের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এসব ক্ষেত্রে ধর্মীয় আইন বা রীতিই সংবিধানের ওপর প্রাধান্য লাভ করেছে।