ভোট কারচুপি, ভোট জালিয়াতি, ভোট ডাকাতি ও দিনের ভোট রাতে করার সহযোগী এবং দমনপীড়নের দ্বারা বিরোধী মতের কণ্ঠরোধে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সহায়তাকারী সরকারি কর্মচারীরা ঘুস, দুর্নীতি ও অন্যান্য ফৌজদারি অপরাধ করে জেল খাটলেও যেন চাকরি না যায় বা চাকরি যাওয়ার ভয় না থাকে এবং তারা যেন অন্ধভাবে সরকারের আনুগত্য করে, সেজন্যই বিগত সরকার জনস্বার্থবিরোধী ও দুর্নীতিসহায়ক ‘সরকারি চাকরি আইন’ জারি করে। জুলাই অভ্যুত্থানের পর জনমানুষের প্রত্যাশা ছিল অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কারের দ্বারা এসবের অবসান ঘটাবে। কিন্তু ঘটল এর উলটো। জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন, দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশন, এমনকি অন্তর্বর্তী সরকারের নীতিনির্ধারক ও শীর্ষ আমলাদের নজরেই আসেনি জনস্বার্থবিরোধী ও দুর্নীতিসহায়ক আইনের এ বিধানগুলো। বরং সরকারি চাকরি আইনের দুর্নীতিসহায়ক বিধান বহাল রেখে অতি সম্প্রতি অধ্যাদেশের দ্বারা ৩৭ক ধারা সংযোজন করে আইনটিকে এ যুগের হাস্যকর হাম্মুরাবি কোডে পরিণত করা হয়েছে, যা জনপ্রশাসনের ইতিহাসে একটি কালো দাগ হয়ে থেকে যাবে। এটা অদক্ষতা, অযোগ্যতা, নাকি অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা, সেটা সময়ই বলে দেবে।
আজ থেকে প্রায় ৪ হাজার বছর আগে ব্যাবিলনের ষষ্ঠ রাজা হাম্মুরাবি (Hammurabi) ২৮২টি আইনের সমন্বয়ে একটি কোড জারি করেন। এ কোডটি লিখিত আদি দণ্ডবিধির অন্যতম একটি দণ্ডবিধি এবং আইনের জগতে একটি মাইলফলক হিসাবে সারা বিশ্বে বিবেচিত হয়ে আসছে। ‘অপরাধ প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত অভিযুক্তকে নির্দোষ বিবেচনা করতে হবে’ (an accused person being considered innocent until proven guilty)-এ ধারণাটি প্রথম এ কোডেই অন্তর্ভুক্ত হয়। কোডটিতে এরূপ অনেক ভালো বিধান যেমন ছিল, তেমনি ছিল অভিজাত শ্রেণিকে অপরাধের দায় থেকে অব্যাহতিসহ অসামঞ্জস্যপূর্ণ ও হাস্যকর অনেক দণ্ডের বিধান। যেমন কোডটিতে চোখের বদলে চোখ, কানের বদলে কান, দাঁতের বদলে দাঁত এবং জিহ্বা কাটার মতো দণ্ডের পাশাপাশি ছিল আঙুর ফল চুরির মতো সামান্য অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ডের বিধান।
হাম্মুরাবি কোডের দণ্ডসংক্রান্ত অসামঞ্জস্যপূর্ণ বিধানের সঙ্গে সরকারি চাকরি আইনের দণ্ডের বিধানের যে মিল রয়েছে, এর কিছু নমুনা তুলে ধরছি। ডিসমিসাল অন কনভিকশন অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী ঘুস, দুর্নীতি, চুরি, ছিনতাই, নারীর শ্লীলতাহানি এবং মাদকসংক্রান্ত অপরাধসহ নৈতিক স্খলনজনিত যে কোনো অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়ে যে কোনো মেয়াদের কারাদণ্ড বা জরিমানা দণ্ড হোক না কেন, কর্মচারী দণ্ড ঘোষণার তারিখ থেকেই চাকরি থেকে বরখাস্ত হতেন। যুক্তিযুক্ত এ আইনটি বাতিল করে বিগত সরকার সরকারি চাকরি আইন জারি করে। এ আইনের ৪২(২) ধারা অনুযায়ী, উল্লিখিত অপরাধে দোষী সাব্যস্ত কর্মচারীর এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হলে বা যে কোনো পরিমাণ জরিমানা দণ্ড হলেও ওই কর্মচারী চাকরিতে বহাল থাকবে। অর্থাৎ এক বছর কারাদণ্ড ভোগ করার পর বা জরিমানার শতকোটি টাকা পরিশোধের পর আবারও নিজ পদে বহাল হবেন। এক্ষেত্রে তাকে কেবল তিরস্কার করেই চাকরিতে বহাল করা যাবে। শুধু তাই নয়, ৪২(৩) ধারা অনুযায়ী এক বছরের বেশি কারাদণ্ড ভোগকারী অর্থাৎ দশ-বিশ বছর কারাদণ্ড ভোগকারী কর্মচারীকেও রাষ্ট্রপতি চাইলে দণ্ডভোগ শেষে চাকরিতে বহাল করতে পারবেন। সত্যি অবাক হতে হয়, যখন সরকারি চাকরি আইন সংশোধনের সময়ও সংস্কারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ অন্তর্বর্তী সরকারের চোখে এরূপ বিধান ধরা না পড়ে। এছাড়া ১৯৮৫ সালের যৌক্তিক শৃঙ্খলাবিধি বাতিল করে বিগত সরকারের জারি করা শৃঙ্খলাবিধিতে দুর্নীতিপরায়ণতার জন্য তিরস্কার দণ্ড ও একাধিকবার দুর্নীতি করার সুযোগের বিধানও সংস্কারের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের চোখে পড়ে না।
উপরন্তু সরকারি চাকরি আইনের ৪২ ধারা সংশোধন না করে এ ধারার বিধানের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ ৩৭ক ধারা সংযোজন করা হয়। নতুন সংযোজিত ধারায় অনানুগত্য, অনুপস্থিতি ও কর্তব্য সম্পাদনে ব্যর্থ হওয়ার কারণে চাকরি থেকে বরখাস্ত করার বিধান সংযোজন করা হয়েছে। ফলে একদিকে নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধে জেল খাটলেও চাকরি যাবে না, অপরদিকে বসের কথা না শুনলে বা অনুপস্থিত থাকলে বা কোনো একটি কাজ করতে ব্যর্থ হলে চাকরি চলে যাবে। এরূপ বিধান কি হাম্মুরাবি কোডের ‘চোখের বদলে চোখ’ কিন্তু ‘আঙুর চুরির জন্য মৃত্যুদণ্ড’-এ বিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়?