
স্বেচ্ছাচারিতার অধিকার কি রাষ্ট্র কাউকে দিয়েছে
ঈদের ছুটির সময় মানুষ একটু স্বস্তি চায়, আনন্দ চায়, পরিবার-পরিজনের সঙ্গে নির্ভার সময় কাটাতে চায়। কিন্তু সেই ছুটির সময়টাতেই যখন অস্থিরতা, হেনস্তা, নিষেধাজ্ঞা আর মৃত্যুর খবর আসে, তখন প্রশ্ন জাগে—এই দেশ কি সত্যিই সব মানুষের জন্য নিরাপদ বাসভূমি হতে পেরেছে? তিনটি ঘটনা ঈদুল আজহার ছুটির সময়কালে সংঘটিত হয়েছে, যার প্রতিটি আমাদের মননে, মানবতায় এবং রাষ্ট্রব্যবস্থায় তীব্র প্রশ্ন তুলে ধরে। প্রথম ঘটনাটি ঘটে টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে। সেখানকার একটি সিনেমা হলে ঈদের দিন থেকে ‘তাণ্ডব’ নামের একটি চলচ্চিত্র প্রদর্শন শুরু হয়। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই স্থানীয় একটি ওলামা পরিষদ বিক্ষোভ মিছিল করে দাবি তোলে যে সিনেমা হল বন্ধ করতে হবে। কারণ হিসেবে বলা হয়, এতে নাকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদানে ক্ষতি হতে পারে, মসজিদ-মাদ্রাসার পরিবেশ বিঘ্নিত হতে পারে এবং ‘অসামাজিক কার্যকলাপ’ বাড়তে পারে। মবের ভয়ে সিনেমার প্রদর্শন বন্ধ হয়ে যায়।
প্রশ্ন হলো, একটি সিনেমা হলে সিনেমা প্রদর্শন হলে কীভাবে মসজিদ বা মাদ্রাসার পরিবেশ বিঘ্নিত হয়? আর অসামাজিক কার্যকলাপ বলতে যদি তারা কিছু বোঝায়, তাহলে তা বন্ধ করার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর, নাকি নিজেদের তৈরি করা নৈতিকতা পুলিশের? এই সমাজ কি তাহলে এই কয়েকজনের দাবি ও হুমকির কাছে জিম্মি? এখানে রাষ্ট্রের অবস্থান কোথায়? ধর্মের নামে এমন সাংস্কৃতিক নিয়ন্ত্রণ কি আমাদের গণতন্ত্র ও বহুত্ববাদকে লঙ্ঘন করছে না?
দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটে সিলেটের সীমান্তবর্তী কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার উৎমাছড়া এলাকায়। ঈদের ছুটিতে পর্যটকেরা সেখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে যান, ছবি তোলেন, সামাজিকমাধ্যমে শেয়ার করেন। এটাই তো স্বাভাবিক, এটাই তো আনন্দের চিহ্ন। কিন্তু হঠাৎই সেখানে হাজির হন স্থানীয় যুব জমিয়তের নেতা মুফতি রুহুল আমিন সিরাজী ও তাঁর অনুসারীরা। তাঁরা সেখানে গিয়ে বলেন, উৎমাছড়া কোনো পর্যটনকেন্দ্র নয়, ছবি আপলোড করা যাবে না, এই এলাকায় কেউ যেন না আসে। আরও বলা হয়, এলাকার মুরব্বিরা বসে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে এখানে কেউ ঢুকতে পারবে না। এ এক অদ্ভুত ঘোষণা! রাষ্ট্র কি তাহলে এখন মুরব্বিদের কাছে ইজারা দিয়ে দিচ্ছে দেশের প্রাকৃতিক স্থানগুলো? তাঁরা যদি বলেন, ‘এই জায়গায় কেউ আসবে না’, তবে সেটা কি আইন? তাঁরা বলছেন, কিছু লোক মদপান করে, অশ্লীল আচরণ করে—সেটা যদি সত্যও হয়, তাহলে তো তার প্রতিকার করার দায়িত্ব প্রশাসনের। এসব প্রতিকারের কি কোনো আইনকানুন নেই দেশে? উৎমাছড়ায় ‘বিচারপতি’ হয়ে গেলেন কিছু আলেম ও যুবক, যাঁদের কথায় মানুষকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, হেনস্তা করা হয়েছে। এগুলো আসলে কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, এটি একটি ভিন্ন ধরনের মানসিক প্রবণতার অংশ, যেখানে কিছু মানুষ মনে করছে, নিজেরা সমাজের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তদাতা। এর পরিণাম ভয়ংকর। কারণ, এতে মানুষের ঘোরাঘুরি, সংস্কৃতি চর্চার স্বাধীনতা, ভ্রমণের অধিকার হুমকির মুখে পড়ে।
তৃতীয় এবং সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটে মানিকগঞ্জের সিংগাইরে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থী শাকিল আহমেদ, বয়স মাত্র ২৪। ফেসবুকে নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে করা একটি পোস্টে তিনি মন্তব্য করেন। সেটা ঘিরে স্থানীয় কিছু লোক তাঁকে ‘নাস্তিক’ বলে চিহ্নিত করে, হুমকি দেয়, তাঁর পরিবারকে ভয় দেখায়। এমনকি তাঁদের বাড়িতে গিয়েও শাসিয়ে আসে। এই মানসিক চাপ, সামাজিক অপমান, পারিবারিক লজ্জা সহ্য করতে না পেরে শাকিল আত্মহত্যা করেন। মৃত্যুর আগে ফেসবুকে চারটি পোস্ট দেন, যেগুলোর একটিতে তিনি স্পষ্ট করে বলেন, তিনি নাস্তিক নন, তাঁর বিশ্বাস আছে, তিনি কখনো নবীকে নিয়ে কটূক্তি করেননি, কিন্তু সবাই তাঁকে ঘৃণা করছে, তাঁর বাবা-মা লজ্জায় পড়ে যাচ্ছেন। তিনি সেই লজ্জা সহ্য করতে পারছেন না। এই লেখা পড়ে যে কারও চোখে জল আসবে। এখন প্রশ্ন হলো, শাকিল কী এমন ‘অপরাধ’ করেছিলেন, যার জন্য তাঁকে মরতে হলো? কে তাঁর বিচার করল? কারও ইচ্ছে হলেই কি কাউকে নাস্তিক ঘোষণা করতে পারে? এমন অধিকার কি রাষ্ট্র কাউকে দিয়েছে?
এই কি সেই বাংলাদেশ, যেখানে তরুণেরা মুক্তভাবে মত প্রকাশের অধিকার দাবি করে অকাতরে জীবন দিয়েছে। একবার নয়, একাধিকবার? এই বাংলাদেশে যখন ধর্মের নামে কাউকে শাস্তি দেওয়া হয়, সামাজিকভাবে তখন প্রশাসন নির্বিকার থাকে কীভাবে? শাকিলের মতো একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, যাঁর পরিবার কৃষিজীবী, যাঁর বড় ভাইয়েরা দেশের বাইরে, যাঁর বাবা তাঁকে নিয়ে গর্ব করতেন—সেই ছেলেটিকে আজ দুনিয়ার অসম্মানের ভয়ে আত্মহত্যা করতে হয়! এটি শুধু একটি আত্মহত্যা নয়, এটি রাষ্ট্র ও সমাজের ব্যর্থতার প্রতীক।
এই তিনটি ঘটনাই একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত—এক জায়গায় সংস্কৃতি, এক জায়গায় ভ্রমণ, এক জায়গায় মতপ্রকাশ—সবকিছুতেই একটা চাপ, একটা ভয়, একটা নিয়ন্ত্রণ চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ধর্মীয় মূল্যবোধের নামে যাঁরা এই সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, তাঁরা আসলে সমাজের একাংশকে চুপ করিয়ে দিতে চাইছেন, তাঁরা একটি একরৈখিক, রুদ্ধ পরিবেশ তৈরি করতে চাইছেন, যেখানে প্রশ্ন থাকবে না, ভিন্নতা থাকবে না, কেবল তাঁদের ইচ্ছাই হবে আইন। অথচ বাংলাদেশ যে স্বপ্ন নিয়ে সৃষ্টি হয়েছিল, তা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমাদের সংবিধানে আছে—ধর্মনিরপেক্ষতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সংস্কৃতির চর্চা, বৈচিত্র্যের মর্যাদা। এই রাষ্ট্র কারও একক মালিকানা নয়, এটি সব নাগরিকের।
- ট্যাগ:
- মতামত
- ঈদের ছুটি
- অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি