
ইরান-ইসরায়েল সংঘাত : পারমাণবিক ঝুঁকি ও বৈশ্বিক অস্থিরতার ছায়া
মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক দৃশ্যপট এমনিতেই জটিল ও অস্থির। দশকের পর দশক ধরে চলমান আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা, জাতিগত বিভেদ এবং ক্ষমতার দ্বন্দ্ব এই অঞ্চলকে একটি বিস্ফোরক রূপ দিয়েছে। সম্প্রতি ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে যে প্রত্যক্ষ সংঘাতের জন্ম হয়েছে, তা কেবল মধ্যপ্রাচ্য নয়, গোটা বিশ্বের জন্য এক গভীর উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ইসরায়েলের পক্ষ থেকে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা এবং সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে সুসংগঠিত হামলা, সেই সাথে উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা ও পরমাণু বিজ্ঞানীদের হত্যার ঘটনা আঞ্চলিক সংঘাতের এক নতুন ও বিপজ্জনক মাত্রা উন্মোচন করেছে। এই আগ্রাসন পারমাণবিক ঝুঁকির এক নতুন ছায়া ফেলেছে এবং বিশ্ব শান্তিকে এক নজিরবিহীন সংকটের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। বিশ্বজুড়ে বিশ্লেষক ও নীতিনির্ধারকরা এই সংঘাতের সম্ভাব্য পরিণতি নিয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।
১৩ জুন ২০২৫ ভোররাতে ইসরায়েলের পক্ষ থেকে ইরানের উপর এক বিশাল আকারের হামলা চালানো হয়। প্রাথমিক হামলার ঢেউ ইরানের বিভিন্ন সামরিক ও পারমাণবিক স্থাপনাকে লক্ষ্য করে পরিচালিত হয়। এর কয়েক ঘণ্টা পর, ১৩ জুন ২০২৫ দুপুরের দিকে ইরানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের তাবরিজ শহরে একটি দ্বিতীয় ও পৃথক হামলার খবর স্থানীয় গণমাধ্যমগুলোতে আসে। এই বহুমুখী হামলা ইরানের সামরিক সক্ষমতা ও পারমাণবিক কর্মসূচির ওপর ইসরায়েলের সরাসরি আক্রমণের ইঙ্গিত দেয়।
ইরানের আধা-সরকারি বার্তা সংস্থা ফার্স নিউজ এজেন্সি জানিয়েছে যে, ইসরায়েলের এই হামলায় অন্তত ৭০ জন নিহত এবং ৩২০ জনেরও বেশি আহত হয়েছেন। হামলার ছবি ও ভিডিওতে ইরানের পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনাগুলো থেকে ধোঁয়া উড়তে দেখা গেছে, যা আক্রমণের তীব্রতা ও ব্যাপকতা প্রমাণ করে। ইসরায়েলি হামলায় নিহতদের মধ্যে ইরানের শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা এবং পরমাণু বিজ্ঞানীরাও রয়েছেন।
আল-জাজিরার তেহরান প্রতিনিধি তোহিদ আসাদি জানিয়েছেন যে, এই হামলায় ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড কর্পসের (IRGC) কমান্ডার-ইন-চিফ হোসেইন সালামি এবং ইরানি সামরিক বাহিনীর চিফ অব স্টাফ মোহাম্মদ বাঘেরি নিহত হয়েছেন। এছাড়াও, ইরানের আধা-সরকারি সংবাদ সংস্থা নুর নিউজ জানিয়েছে যে, ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির উপদেষ্টা আলী শামখানি ‘মারাত্মকভাবে আহত’ হয়েছেন।
তাসনিম নিউজ অনুযায়ী, খাতাম আল-আনবিয়া সদর দপ্তরের কমান্ডার মেজর-জেনারেল গোলামালি রশীদও নিহত হয়েছেন। একইসাথে, দুটি শীর্ষ পরমাণু বিজ্ঞানী ফেরেদুন আব্বাসি ও মোহাম্মদ তেহরানচি লক্ষ্যবস্তু হত্যার শিকার হয়েছেন। আব্বাসি ইরানের পারমাণবিক শক্তি সংস্থার প্রাক্তন প্রধান ছিলেন, আর তেহরানচি ছিলেন ইসলামিক আজাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান। এই হত্যাকাণ্ডগুলো ইরানের সামরিক ও বৈজ্ঞানিক সক্ষমতার ওপর ইসরায়েলের সরাসরি আঘাতের ইঙ্গিত দেয়, যা তেহরানকে কঠোর প্রতিশোধের দিকে ঠেলে দিতে পারে।
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু একটি পূর্ব-রেকর্ডকৃত বার্তায় দাবি করেছেন যে, ১৩ জুন ২০২৫ ভোরবেলার এই হামলাগুলোর লক্ষ্য ছিল ইরানের পারমাণবিক অবকাঠামো এবং ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কারখানাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত করা। তার মতে, ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সক্ষমতা রোধ করা এবং ইসরায়েলের নিরাপত্তার হুমকি মোকাবিলাই ছিল এই হামলার উদ্দেশ্য।
তিনি আরও বলেছেন যে, ইরান নয়টি পারমাণবিক বোমা তৈরির মতো ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করেছে এবং বিশাল ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের মজুদ গড়ে তুলেছে, যা কয়েক মিনিটের মধ্যে ইসরায়েলে পৌঁছাতে পারে। নেতানিয়াহু জোর দিয়ে বলেছেন, ‘যখন শত্রু আপনাকে ধ্বংস করার ক্ষমতা তৈরি করে, তাকে থামান। আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এই হুমকির মধ্যে রেখে যেতে পারি না।’
তবে, ইসরায়েলের এই আগ্রাসনের জবাবে তেহরান কঠোর প্রতিক্রিয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি হুঁশিয়ারি দিয়েছেন যে, এই হামলার পর ইসরায়েলকে ‘তীব্র ও বেদনাদায়ক’ পরিণতির সম্মুখীন হতে হবে। তিনি দৃঢ়ভাবে বলেছেন, ‘আল্লাহর ইচ্ছায়, ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের সশস্ত্র বাহিনীর শক্তিশালী হাত ইসরায়েলকে শাস্তি ছাড়া যেতে দেবে না।’
এই ধরনের কঠোর প্রতিক্রিয়াশীল বক্তব্য মধ্যপ্রাচ্যে এক সর্বাত্মক যুদ্ধের গভীর আশঙ্কার জন্ম দিচ্ছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অবশ্য ফক্স নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে দাবি করেছেন যে, ওয়াশিংটন ইসরায়েলি হামলায় জড়িত ছিল না।