
সরকার ক্ষণিকের কিন্তু রাষ্ট্র চিরদিনের
দীর্ঘ ছুটির অবসান হতে চলেছে। দেশে বেশির ভাগ অফিস-আদালত (সরকারি বা বেসরকারি) এখনো খোলেনি, কিন্তু জীবনের প্রবাহ কোথাও বন্ধ হয়নি। বাইরে থেকে তালাবদ্ধ রাখা হলেও ভেতরে সবই চলছে। সরকারের প্রধান ব্যক্তির বিদেশ সফর বন্ধ হয়নি। রাজনৈতিক নেতাদের কর্মকাণ্ড এত দিনে নতুন নতুন দিকে মোড় নিচ্ছে। জোটবদ্ধ দলগুলোর মধ্যে নতুন বোঝাপড়া হচ্ছে। কিন্তু যাঁরা বিনা কারণে, বিনা বিচারে জেলে আটক হয়ে অনিশ্চিত সময় কাটাচ্ছেন, তাঁদের জীবন হচ্ছে ভয়াবহ কষ্টকর। তাঁদের অসহায় পরিবারগুলোর আহাজারি করার কোনো উপায় নেই। যেসব আইনজীবী সারা বছর বসে বসে দিন কাটান, তাঁদের কাছে এখন মামলা প্রচুর। পরিবারগুলোর থানা-পুলিশ আর কোর্ট-কাচারিতে ধরনা দেওয়া ছাড়া যেন কোনো কাজ নেই। কিন্তু ছুটিতে তো কোনো কাজ হওয়ার নয়। একটি মাসের প্রায় অর্ধেক সময় ছুটিতে কেটে গেল! তেমনি করেই মাসের পর মাস রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় কেটে যাচ্ছে।
বড় ধরনের সমস্যা হচ্ছে নির্বাচন নিয়ে। ডিসেম্বর না জুন? শেষ পর্যন্ত ঘোষণা হলো এপ্রিল। তবে সর্বশেষ শোনা যাচ্ছে, ড. ইউনূসের লন্ডন বৈঠকে এটা ফেব্রুয়ারিতে হওয়ার সমঝোতা হতে পারে। নির্বাচন পেছানো হলে কিংবা এগিয়ে আনলে কার লাভ বা ক্ষতি? অন্তর্বর্তী সরকার ‘সংস্কার’ নামে একটা বস্তুকে নিয়ে জাতিকে অনেক জ্ঞান দিতে চাইলেও কোনো কাজ হচ্ছে না। কারণ, দেশের মানুষ এসব এনজিওওয়ালা সবাইকে চেনে। তাঁরাও এত নির্বোধ! তাঁরা কি জানে না যে বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ প্রবর্তন করতে বা রামমোহন রায়ের সতীদাহ প্রথা বন্ধ করতে কত কর্মদিবস লেগেছে? কর্মদিবসে কাজ হয়নি। ব্রিটিশ সরকারের পরিপত্র জারি হলেও কর্মবৎসরেও তা হয়ে ওঠেনি। রাষ্ট্রের সংস্কার অবশ্যই প্রয়োজন। কিন্তু সেই সংস্কার হবে কীভাবে?
দেশের শতকরা কতজন সংবিধান বোঝেন? যাঁরা এত বছর সংসদ সদস্য হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে কতজন সংবিধানটি মনোযোগ দিয়ে পড়েছেন? পড়ার সময়ই পাননি। এ ব্যাপারে মানুষকে সচেতন করার জন্য গত ৫৪ বছরে কোনো চেষ্টা করা হয়েছি কি? অন্তত শিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে সংবিধান অথবা নাগরিকের অধিকার কী আছে, সেই ধারণা দেওয়ার চেষ্টা কি হয়েছে? সাফ উত্তর—‘হয়নি’। সংবিধান বিশেষজ্ঞরা এসেই পুনর্লিখনের কথাটি বলে জাতিকে হকচকিয়ে দিলেন। ১৯৭২ সালের সেই সব নেতা ও বিশেষজ্ঞের তৈরি সংবিধান পুনর্লিখন করতে হবে। হয়তো পৃথিবীতে অন্য কোথাও এ রকমটি ঘটতে পারে। আমদানি করা পশ্চিমা বিশেষজ্ঞরা হয়তো এসব ভালো করেই জানেন। সব ক্ষেত্রেই সংস্কার এবং বিচার—সেসব করতে শতবর্ষ লেগে যাবে। এত দিন কি অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান ঘনঘন বিদেশ ভ্রমণ করে রাষ্ট্রের দায়িত্ব পালন করে যাবেন? জনগণের এখন কী সমস্যা হচ্ছে, তার খবর না নিয়ে নিজেদের সাফল্যগাথা গাইতে গিয়ে হাস্যকর হয়ে যাচ্ছেন। সরকারের চেয়ারখানা নিয়ে মানবজাতির সংখ্যা গণনার প্রত্যুষ থেকেই এক ঝামেলা চলছে। কেউ এটা ছাড়তে চান না। চেয়ার ছাড়াও যে অনেক বড় ক্ষমতাবান হওয়া যায়, তা কেউ ভাবতেই পারেন না। অনেক চেয়ারওয়ালা কালের গর্ভে সাম্প্রতিক কালেই হারিয়ে গেছেন। অথচ একটুখানি কাণ্ডজ্ঞান ও মানুষের ভালোবাসা নিয়ে মনীষীরা অনেক শতাব্দী পার করে দিচ্ছেন।
বাংলাদেশের রাষ্ট্র বিবেচনা করলে আমরা বহুবার ক্রান্তিকাল অতিক্রম করেছি। গণতন্ত্রের লড়াইয়ের জন্য, এক গণতন্ত্র থেকে আরেক গণতন্ত্রে উত্তরণের জন্য আবার অভ্যুত্থান থেকে গণতন্ত্রে ফেরা—এ সবই ক্রান্তিকাল। এর মধ্যে আবার সামরিক শাসন এসেছে। গণতন্ত্র সুদীর্ঘ দিন গৃহবন্দী থেকেছে, সংবিধান অকার্যকর থেকেছে। বিচার বিভাগের মানবাধিকার কমিটি তখন চর্চার বাইরে। এমনি অসংখ্য বিবেচনা নিয়ে এবং সর্বোপরি দেশের কোন ধরনের মানুষ সংবিধান লঙ্ঘন করে, তা বিচার করেই রাষ্ট্র সংস্কার দরকার। যাঁরা এ কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন, তাঁরা সারা বিশ্বের বিপ্লব সম্পর্কে জানেন। কেমন ছিল বিপ্লবের পরের দিনগুলো? কীভাবে রাষ্ট্র জনগণের ইচ্ছাকে কার্যকর করেছে, তা-ও তাঁদের জানা। সেসব দিকে তাঁরা খুব একটা গিয়েছেন? এত অল্প সময়ের মধ্যে কী করে সম্ভব? হ্যাঁ, একটা ভালো বুদ্ধিদীপ্ত সূচনা হতে পারে এবং তা-ও আবার হতে হবে জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে।
এই জনপ্রতিনিধিদের আমরা দেখে আসছি অনেক দিন ধরেই। তবে যেকোনো পরিবর্তন কখনো কখনো কিছু গুণগত পরিবর্তন এনে দেয়। কিন্তু এবারে সেসব লক্ষণ একেবারেই দেখা যাচ্ছে না। যাঁরা পরিবর্তন এনেছেন অতি অল্প সময়ে, মতান্তরে মেটিকুলাস ডিজাইন অনেক দিনের, তাঁদের ডিজাইনের মধ্যে রাজনৈতিক দলের বিষয়টিও ছিল, যা এখন কার্যকর। রাজনৈতিক দল এবং তার প্রাত্যহিক কর্মকাণ্ডের মধ্যেই একধরনের সংস্কৃতি আছে, যা দলকে একটা বৃত্তের মধ্যে আটকে দেয়। সেই বৃত্ত থেকে কতটা বেরিয়ে আসতে পারবে এই নতুন দল, তা সবাইকে একটা প্রশ্নের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। আবার মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা আকার-ইঙ্গিতে এটাও বুঝিয়ে দিয়েছেন, দলটি তাঁদেরই। তাই সবাই দলটিকে কিংস পার্টি বলেই জানছেন।
নির্বাচন নিরপেক্ষ হলে জনগণ কখনোই সরকারি দলকে ভোট দিতে চায় না। সে জন্যই সরকার কারচুপির পথ বেছে নেয়। যেসব দল আবার জেতার সঙ্গে সঙ্গে হারতে শেখে, তাদের জন্য কিছু আসে-যায় না। তারা শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন চায়, আরও শক্তিশালী প্রশাসন চায়। এত দ্রুত কি আমরা সেই অবস্থার দিকে যেতে পারব? এবারের আন্দোলনে বিপুল পরিমাণ ছাত্র অংশ নিয়েছিল—একেবারে প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত। আন্দোলন শেষ হলো। কিন্তু ছাত্ররা কি ক্লাসে ফিরে গেল? না বুঝেই ছাত্ররা আরেকটা আন্দোলন করে অটোপাস আদায় করে নিল। এর পরেও হাজার হাজার শিক্ষার্থী পরীক্ষা না দিয়েই ওই অটোপাস আন্দোলনের পথ খুঁজে বের করল। অটোপাসের মতো একটা কলঙ্ক চিহ্ন তাদের একাডেমিক ইতিহাসের সঙ্গেযুক্ত হয়ে গেল।