
উচ্চ মূল্যস্ফীতির হার বিবেচনায় অযৌক্তিক ব্যয় কমিয়ে আঁটসাঁট বাজেট প্রস্তাবই কাঙ্ক্ষিত ছিল
বৈষম্যহীন ও টেকসই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ার প্রত্যয় নিয়ে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য নয়া বাজেট প্রস্তাবনা পেশ করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা। এটি তার ও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম বাজেট। এর আগে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বাজেটের আকার দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে মোট বাজেটের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ১০ হাজার ৫২৩ কোটি টাকা। ১৫ বছর পর ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তা ৬২১ দশমিক ১২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকায়। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। চলতি বছরের বাজেটের তুলনায় তা ৭ হাজার কোটি টাকা বা দশমিক ৮৮ শতাংশ কম। আর সংশোধিত বাজেটের তুলনায় ৪৬ হাজার কোটি বা ৬ দশমিক ১৮ শতাংশ বেশি। এ বাজেটের আকার জিডিপির ১২ দশমিক ৭ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের আকার ছিল জিডিপির ১৪ দশমিক ২০ শতাংশ। স্বাধীনতার পর দেশের প্রথম বাজেটের পরিমাণ ছিল ৭৮৬ কোটি টাকা। প্রস্তাবিত নয়া বাজেট ওই বাজেট থেকে ১০০৫ গুণ বেশি। তবে এবারের বাজেটে আনুষ্ঠানিকতা কম। রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নেই বললেই চলে। পক্ষে-বিপক্ষে কোনো মিছিল, স্লোগান নেই। এটি উত্তাপহীন বাজেট।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাজেট দ্রুত সম্প্রসারিত হলেও সমস্যা হয়েছে সেটি বাস্তবায়নে। তার প্রধান কারণ কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় রাজস্ব আহরণে ঝুঁকি। এবারের বাজেট অনেকটা সংকোচনমূলক। এতে কৃচ্ছ্রসাধনের চেষ্টা করা হয়েছে। অন্যান্য বছর ১২-১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল বাজেটে। এবার তা ঋণাত্মক দশমিক ৮৮ শতাংশ। মূল্যস্ফীতির হার গড়ে প্রায় ১০ শতাংশ ধরে নিলে বাজেটের প্রবৃদ্ধি হবে আরো বেশি নেতিবাচক। দেশের উচ্চ মূল্যস্ফীতির হার বিবেচনায় অযৌক্তিক ব্যয় কমানোর মাধ্যমে একটি আঁটসাঁট বাজেট প্রস্তাবই এবার কাঙ্ক্ষিত ছিল। বাজেট বাস্তবায়নের গুণগত মান নিশ্চিত করা হলে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে বিদ্যমান চড়া মূল্যস্ফীতি অবদমনে প্রস্তাবিত বাজেট সহায়ক হবে।
প্রস্তাবিত বাজেটে মোট রাজস্ব প্রাক্কলন করা হয়েছে ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে এনবিআর উৎস থেকে আসবে ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা। এ লক্ষ্য অর্জন করতে হলে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের প্রবৃদ্ধি হতে হবে এবারের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রার ৭ দশমিক ৬৬ শতাংশ এবং মূল লক্ষ্যমাত্রার ৩ দশমিক ৯৬ শতাংশ বেশি। সাম্প্রতিক আর্থিক সংকট, নিম্ন জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও আমদানি নিয়ন্ত্রণের কারণে এ প্রবৃদ্ধি অর্জন করা খুবই কঠিন হবে। কর ও ভ্যাটের আওতা ও হার বৃদ্ধি এবং করছাড়ের মাত্রা হ্রাসের কারণে মানুষের ওপর আর্থিক চাপ বাড়বে। তবে এ চাপ জনগণকে সইতে হবে। বর্তমানে আমাদের কর-জিডিপি অনুপাত ৭ শতাংশের মতো। এটি এশিয়ার সর্বনিম্ন। ক্রমাগত বাজেট ঘাটতি হ্রাস এবং দেশী ও বিদেশী ঋণের ওপর নির্ভরতা কমানোর জন্য কর-জিডিপির অনুপাত বাড়িয়ে ন্যূন পক্ষে ২০ শতাংশে উন্নীত করা দরকার। প্রস্তাবিত বাজেটে কর-জিডিপির অনুপাত হবে ৯ শতাংশ। নয়া বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ কোটি ২৬ লাখ টাকা, যা জিডিপির ৩ দশমিক ৬ শতাংশ। অন্যান্য বছরের তুলনায় তা কম। এ ধারা অব্যাহত থাকলে বিদেশী ঋণের ওপর নির্ভরতা হ্রাস পাবে এবং স্বনির্ভর অর্থনীতি গড়ার লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হবে।
গত বাজেটে জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। পরে তা নামিয়ে দেয়া হয় ৬ দশমিক ৫ শতাংশে। সংশোধিত বাজেটে আরো নামিয়ে তা করা হয় ৫ দশমিক ২৫ শতাংশ। প্রাথমিক হিসাবে অর্জনের পরিমাণ লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক কম। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন হলো ৩ দশমিক ৩ থেকে ৩ দশমিক ৯ শতাংশ। আগামী বছরের প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। তবে আগামী বাজেট বাস্তবায়নের হার ও গুণগত মান সন্তোষজনক না হলে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব নাও হতে পারে। প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যস্ফীতির হার ধরা হয়েছে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। বাস্তবে এটা হয়তো আরো বেশি হবে। বর্তমানে গড় মূল্যস্ফীতির হার প্রায় ১০ শতাংশের কাছাকাছি রয়েছে। গত মে মাসে ছিল ৯ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ, এপ্রিলে ৯ দশমিক ১৭ শতাংশ। জুন শেষে এ হার ৮ শতাংশে নেমে আসবে বলে ধারণা করছে সরকার। গত মে মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৮ দশমিক ৫৯ শতাংশ, এপ্রিলে যা ছিল ৮ দশমিক ৬৩ শতাংশ। সম্প্রতি দেশে কৃষির উৎপাদন, বিশেষ করে বোরো ধানের উৎপাদন ভালো হওয়ায় আমাগী দিনগুলোয় মূল্যস্ফীতির হার নমনীয় থাকবে বলে আশা করা যায়।
প্রস্তাবিত বাজেটে মোট উন্নয়ন ধরা হয়েছে ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬০৯ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ৩১ শতাংশ। পরিচালন বা অনুন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৯৮ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা, যা মোট বাজেটের ৬৯ শতাংশ। এটি ভারসাম্যপূর্ণ নয়। এবার পরিচালন ব্যয় বেশি হওয়ার অন্যতম কারণ সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা খাতে বেশি বরাদ্দ রাখা। উদ্দেশ্য বিশেষ প্রণোদনা প্রদান। বর্তমানে সচিবালয় ও এনবিআরের স্থাপনাগুলোয় যা ঘটছে, দেশবাসী তা প্রত্যক্ষ করছেন। তাদের সেবার মান সম্পর্কেও করদাতারা অবহিত আছেন। এ অবস্থায় পুরনো কর্মচারীদের আর্থিক সুবিধা আর না বাড়িয়ে নতুন কর্মসংস্থানের উদ্যোগ গ্রহণ করাই যুক্তিপূর্ণ নয় কি? দেশের শতকরা ৯০ ভাগ বেসরকারি চাকরিজীবীদের জন্য সরকারের কোনো প্রণোদনা থাকবে কি? অনেকে মনে করেন, সরকারি কর্মচারীদের ৫-১০ শতাংশ হারে মহার্ঘ ভাতা কিংবা বিশেষ প্রণোদনা প্রদানের প্রস্তাব বৈষম্যমূলক এবং মূল্যস্ফীতির হার বাড়ানোয় ভূমিকা রাখবে।
প্রস্তাবিত কৃষি বাজেট গতানুগতিক। আগামী অর্থবছরে কৃষিবিষয়ক পাঁচটি মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৪৫ হাজার ২০৮ কোটি টাকা। এ টাকা মোট বরাদ্দের ৫ দশমিক ৮৬ শতাংশ। এর মধ্যে শস্য কৃষি খাতের জন্য রাখা হয়েছে ২৭ হাজার ২২৪ কোটি টাকা, যা মোট বরাদ্দের ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশ। বাকি ২ দশমিক ৪১ শতাংশ মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ, বন ও পরিবেশ, ভূমি ও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়গুলোর জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে। এটা অপ্রতুল। দিনের পর দিন বাজেটে বৃহত্তর কৃষি খাতের হিস্যা হ্রাস পেয়েছে। ২০১১-১২ সালে বৃহত্তর কৃষি খাতের হিস্যা ছিল মোট বাজেটের ১০ দশমিক ৬৫ শতাংশ। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে তা নেমে এসেছে ৫ দশমিক ৮৬ শতাংশে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছিল ৬ দশমিক ৬৫ শতাংশ। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তা ১ দশমিক ৭৯ শতাংশ নেমে আসছে। উচ্চ খাদ্য মূল্যস্ফীতি হ্রাস ও এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে খাদ্য এবং পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য কৃষি খাতে ন্যূনপক্ষে মোট বাজেটের ১০ শতাংশ অর্থ নিয়োজিত করা উচিত।