
মিথ্যা+ঘৃণা+হিংসা+দুর্নীতি=মোদি
আপনারা প্রত্যেকেই ভেবেছিলেন, অপারেশন সিঁদুর হলো দেশ রক্ষার, পাকিস্তানি জঙ্গি হামলার এক অভিযান। এখন বোঝা যাচ্ছে পরিষ্কার, ওটা ছিল আদতে এক রাজনৈতিক প্রচারের অঙ্গ। একটা পরিষ্কার জিনিস বুঝে নিন, সীমান্ত প্রহরার জন্য, দেশের বিরুদ্ধে আক্রমণকে প্রতিরোধ করার জন্য একজন জওয়ানকে লড়তে হয়, সেই লড়াইয়ের নাম কী? সেই লড়াইয়ের নাম অপারেশন সিঁদুর না কুমকুম, তাতে তার কিছু যায় আসে না। এবং সেই লড়াইও যে তার হাতে নেই সেটাও তো সবাই জানে। মানে মোদিজী বললেন, আমি সেনাকে বলে দিয়েছি, এবার যা করার করে নিন, গ্রিন সিগন্যাল দিয়েছি। এই কথাটার মানে এরকম নয় যে, এবার সে তার ইচ্ছামতো লড়বে। সে কতটুকু লড়বে, সে কখন লড়াই থামাবে, সেটা নির্ভর করে সরকার, রাষ্ট্রপ্রধানের ওপর। আর রাষ্ট্রপ্রধান মোদিজীর মতো অন্যের আদেশে চলা একজন হলে সেই প্রভুর কথামতোই যুদ্ধ শুরু হবে বা থামবে। যেমনটা এক্ষেত্রে হয়েছে।
নয়-নয়বার আমেরিকার রাষ্ট্রপ্রধান, সেখানকার প্রেস সচিব, বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আমেরিকার নির্দেশেই যুদ্ধবিরতি ঘোষণা হয়েছে, এমনকি আমেরিকার আদালতেও জানানো হয়েছে যে, আমেরিকার মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হয়েছে। পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধান থেকে মিডিয়া জানাচ্ছে-হ্যাঁ, আমেরিকার হস্তক্ষেপে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা হয়েছে। তার বিরোধিতা আমাদের দেশে কে করেছেন? আমাদের রাষ্ট্রপ্রধান ৫৬ ইঞ্চ কা সিনাওলা, পা থেকে মাথা পর্যন্ত মিলিটারি পোশাক পরে ছবি তোলানেওলা এ নিয়ে একটা কথাও বলেছেন? না, বলেননি। যে রাষ্ট্রপ্রধান ট্রাম্প সরকারের মতো নির্ঘিব্নে স্লোগান দিতে পারেন, তিনি কোন মুখে ঘাড় উঁচু করে কথা বলবেন? সেই তিনি আসলে সিঁদুর বেচতে নেমেছেন, হ্যাঁ আক্ষরিক অর্থেই সিঁদুর বেচনেওয়ালা হয়ে উঠেছেন।
অপারেশন সিঁদুর এখন এক রাজনৈতিক প্রচারের অঙ্গ, যে প্রচার নিয়ে মোদিজি হাজির হয়েছিলেন উত্তরবঙ্গে। অপারেশন সিঁদুরের কারণ আর তার বাস্তবতা নিয়ে যখন দেশের সাংসদরা বিদেশ-বিভুঁইয়ে ভারতের কথা বলছেন, তখন দেশের মধ্যে মোদিজি নির্বাচনি প্রচার ছাড়া কিচ্ছু করছেন না। তিনি বলছেন হিংসার কথা। গান্ধী হত্যাকারী নাথুরাম গডসের দলের মুখে শুনতে হবে অহিংসার কথা? গত ২৪ মে নির্দোষ চার মুসলিম যুবককে গোমাংসের নামে পিটিয়ে হত্যার চেষ্টা করে বজরং দলসহ অন্য হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের কর্মীরা। আতরৌলির নিবাসী। গরিব মুসলিম পরিবারের ওই চারজন আলিগড়ের মাংস কারখানা থেকে মাংস কিনে লাইসেন্সধারী দোকানদারদের মাংস সরবরাহ করেন। ২৪ মে সকাল ৮টায় ওই চারজন আলিগড়ের বাজারে যাচ্ছিল, মোটরসাইকেল করে গাড়ির পিছু নেওয়া হয়। ততক্ষণে আরএসএস এবং গোরক্ষক দলের লোকরা অল্পবয়সিদের আলিগড় শহরের বাইরে জড়ো করেছে। আর তারা বলতে শুরু করে, ‘গাড়ির মধ্যে গোমাতার মাংস আছে।’ এরপর গাড়ি থেকে চালক আকিলসহ চারজনকে নামিয়ে বেধড়ক মারধর করা শুরু হয়। ভিড়ের মধ্য থেকে কেউ ভিডিও করে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করেছিল, সেটা দেখে কিছুক্ষণের মধ্যে তিনটি থানার পুলিশ বাহিনী সেখানে এসে পড়ে। তখন আক্রান্ত এক যুবক প্রাণ বাঁচাতে পুলিশের গাড়িতে ঢুকে পড়ে। কিন্তু পুলিশ বাঁচানোর বদলে তাকে ধাক্কা দিয়ে ফের উন্মত্ত ভিড়ের মধ্যে ঠেলে দেয়। মূক দর্শক পুলিশ তামাশা দেখতে থাকে। দেড় ঘণ্টা ধরে মারতে থাকার পর সংজ্ঞাহীন ওই যুবকরা মরে গেছে বলে মনে করে হিন্দুত্ববাদী দুষ্কৃতিরা। তখন পুলিশ সেখান থেকে তাদের তুলে আলিগড়ের মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। আর মোদিজি এখানে এসে বাংলাতে হিংসার কথা বলছেন? মানুষ শুনবে? তিনি ভয়, সন্ত্রাসের কথা বলছেন?
ভিএইচপির প্রাণনাশের হুমকির ভয়ে গত মাসখানেকের ওপর ছত্তিশগড়ে ঘরছাড়া এক খ্রিষ্টান পরিবার, জানে না কবে ঘরে ফিরতে পারবে। কেরালার এই খ্রিষ্টান পরিবারের সদস্যরা ছত্তিশগড়ের কাওরধা এলাকায় অনেকদিন ধরেই আছেন। তারা এখন প্রাণ বাঁচাতে গোপনে পালিয়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। ফাদার হোসে থমাসের পুত্র জোশুয়া হোসে থমাস জানিয়েছেন, তাদের পরিবার পরিচালিত একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুল ঘিরেই মূল সমস্যা। ১৮ মে, রোববার গির্জার প্রার্থনার সময় আরএসএস ও ভিএইচপির লোকজন এসে হামলা চালায়। তাদের অভিযোগ, পরিবারটি জোর করে ধর্মান্তকরণ করাচ্ছে। হামলায় তার মা ও ছোট ভাই আহত হন। পুলিশ উলটো ফাদার হোসে থমাসকে গ্রেফতার করে। মিথ্যা এফআইআর দায়ের করা হয় এবং থানাতেই পরিবারকে হুমকি দেওয়া হয়। জানা যাচ্ছে, গত ২৯ এপ্রিল, বিজেপি জেলা সভাপতি রাজেন্দ্র চন্দ্রবংশী ফোনে হুমকি দেন, সুশীল শিন্ডের সন্তানদের ট্রান্সফার সার্টিফিকেট না দিলে স্কুল বন্ধ করে দেবেন। সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় সংবাদমাধ্যম একটি মিথ্যা খবর প্রচার করে যে, ট্রান্সফার সার্টিফিকেট এবং ফি মাফের বিনিময়ে ধর্মান্তকরণ করানো হচ্ছিল। তারপর ১৮ মে’র প্রার্থনার সময় বজরং দল ও ভিএইচপি ‘জয় শ্রী রাম’ স্লোগান দিতে দিতে গির্জায় ঢুকে পড়ে, মায়ের ও ভাইয়ের ওপর হামলা চালায়। এ ঘটনা ঘটে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বাঘেল, কাওরধা পুলিশ এবং মিডিয়ার সামনেই। ভয়ে কিশোরীরা বাথরুমে লুকিয়ে পড়লে হামলাকারীরা দরজা ভেঙে তাদের ওপরও হামলা চালায়। ছত্তিশগড়ে ক্ষমতায় কে? মোদিজী বাংলাতে এসে ভয়-সন্ত্রাসের কথা বলছেন? মাত্র গত পরশু ত্রিপুরাতে একটি ছেলে আল্লা কে বন্দে গানটি গাইছিল, তাকে ঘিরে ধরে মারা হয়, সে হাতজোড় করে ক্ষমা চাইছিল। ত্রিপুরাতে ক্ষমতায় কে? মোদিজী বাংলাতে এসে হিংসার কথা বলছেন কোন মুখে?
তিনি দুর্নীতির কথা বলছেন? আমার তথ্য নয়, গতকাল বের হয়েছে রিজার্ভ ব্যাংকের তথ্য, রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া জানিয়েছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ব্যাংক জালিয়াতির পরিমাণ প্রায় তিন গুণ বেড়ে ৩৬,০১৪ কোটি রূপিতে পৌঁছেছে, যেখানে আগের বছর এই অঙ্ক ছিল ১২,২৩০ কোটি রূপি। কেন বাড়ল? তার কারণ হিসাবে বলা হয়েছে, জালিয়াতির ধরণ পালটে গেছে, জালিয়াতেরা অনেক বেশি বেশি করে রাজনৈতিক সংরক্ষণ পাচ্ছে। অবাক করার মতো ঘটনা হলো, মোট জালিয়াতির পরিমাণ বেড়েছে ঠিকই, তবে জালিয়াতির মামলার সংখ্যা কমে গেছে। তার মানে জালিয়াতি আগের থেকে বেশি টাকার পরিমাণে হচ্ছে।
আর মিথ্যা প্রচার, গুজব ছড়ানো ইত্যাদি বিষয় আরএসএস-বিজেপি শিখেছে গোয়েবলসের কাছ থেকে, যার তত্ত্ব ছিল-একটা মিথ্যাকে বারবার বলো, বারবার বলো, এতবার বলো যেন অধিকাংশ মানুষ তা বিশ্বাস করে নেয়। তার সঙ্গে গোয়েবলস বলেছিল, ছোট মিথ্যা নয়, এত বড় মিথ্যা বলো, বিগ লাই যে, মানুষটা সেই এত বড় মিথ্যার তল খুঁজে পাবে না। মানে ধরুন এন্টায়ার পলিটিক্যাল সায়েন্সে সাবজেক্ট, মানে ওই এন্টায়ার পলিটিক্যাল সায়েন্সটাই নেই। সেটা বুঝতেই বছর কেটে যাবে। এটা ছিল গোয়েবলসের বিগ লাইয়ের তত্ত্ব। আগে বলতাম কিন্তু এখন বুঝতে পারছি ভুল বলেছিলাম। ডাহা ভুল। আরএসএস-বিজেপি আরও উন্নত মিথ্যা প্রচারযন্ত্র বানিয়ে ফেলেছে। আরও নতুন নতুন কায়দায়। বিষ ঢালছে সমাজে। অবিরাম। কিন্তু সে বিষ এক ঝটকায় বোঝা যাবে না। সে বিষ ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়বে সমাজে। আপনি টের পাওয়ার আগেই আপনার পরিবারে, বন্ধু মহলে, অঞ্চলে, জেলায়, রাজ্যে, দেশে বিষবৃক্ষে ফুল ধরবে। মিথ্যার ফুল। হঠাৎ আপনার বন্ধুকে অপরিচিত মনে হবে। হঠাৎ আপনার পড়শির মুখে এমন কথা শুনবেন, যা কল্পনারও বাইরে। বিজেপি সেই কাজটা করছে, প্রকাশ্যেই করছে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- জঙ্গি হামলা
- সামরিক অভিযান