
চাপ না দিয়ে সরবরাহকারীদের সহায়তা করতে হবে
সরবরাহ ব্যবস্থা, মজুদ, সংরক্ষণ ও চাহিদা—এগুলো খাদ্যপণ্য ব্যবস্থাপনার অন্যতম উপাদান। দেশে যেসব কৃষিপণ্য বিশেষত মরিচ, হলুদ, আনারস ও টমেটো উৎপাদিত হয়, সেগুলো যদি ভালোভাবে সংরক্ষণ করা যায় তাহলে সারা বছরই চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি ভালো দামও পাওয়া যাবে। যেহেতু দেশে প্রচুর আনারস উৎপাদন হয়, সংরক্ষণের পাশাপাশি আনারসের জুস রফতানি করা সম্ভব। কৃষিপণ্যের অনেক বৈচিত্র্য আছে। এ বিষয়ে উদ্যোক্তা, সরকার ও নীতিনির্ধারকদের সম্মিলিতভাবে অনেক কিছুই করা উচিত ছিল। কিন্তু আমাদের ব্যর্থতা আছে। কারণ আমরা তা করতে পারিনি। তবে বিচ্ছিন্নভাবে অনেকেই অনেক কিছু করছে। কিন্তু সরকার একটি নীতিমালা প্রণয়ন করবে বা সহায়ক ভূমিকা পালন করবে—সেটি করতে পারেনি।
আন্তর্জাতিক বাজারের অনুকূল এবং ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ এবং মনিটরিংয়ের মাধ্যমে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নিত্যপণ্যের মজুদ, সরবরাহ ব্যবস্থা ও প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে পেরেছে। এবারই প্রথম কোনো ধরনের আইটেমের সংকট হয়নি। বাজারও সহনীয় ছিল। আন্তর্জাতিক বাজারেও জিনিসপত্রের দাম কমছে।
আমাদের দেশে যেসব পণ্য উৎপাদন হয় সেগুলোর সংরক্ষণ ও মজুদের জন্য কাজ করতে হবে। পৃথিবীর সব দেশেই সরকারের কাছে খাদ্যপণ্যের মজুদ থাকে। কিন্তু যখনই সরবরাহে কোনো আইটেমের ঘাটতি পড়ে বা বিশ্ববাজার ঊর্ধ্বমুখী তখন মজুদ থেকে পণ্য বাজারে ছেড়ে দিয়ে বাজারকে সহনীয় রাখে। বাংলাদেশ সরকারের পর্যাপ্ত মজুদ নেই। আমরা যারা আমদানি করি তাদের চাপাচাপি না করে বরং সহায়ক ভূমিকা পালন কিংবা উপদেশ দেন। আমাদের ডলার সংকট ছিল। আমাদের অনেক সমস্যা রয়েছে। তখনো অংশীজনদের ডেকে আলোচনা করতে বলেছি। কিন্তু সরকার অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা না করে অনেক আইন করে ফেলে। এটা আমাদের জন্য দুর্ভাগ্য। আমাদের অংশীজনদের কথা সরকার কিংবা প্রশাসন শোনে না। তবে সরকার আমাদের চেয়ে অনেক ভালো বোঝে। কিন্তু যারা ব্যবসায়ী বা অংশীজন রয়েছেন তারা তিন-চারটি পণ্য নিয়ে কাজ করেন তাদের সেসব পণ্যের আদি-অন্ত জানতে বা বুঝতে হয়। এসব বিষয় নিয়ে সরকার আলোচনা করলে তখন আমাদের সুবিধা-অসুবিধা বলতে পারি। সবার কথা শোনার পর সরকার একটি সিদ্ধান্ত দেবে। কিন্তু আমাদের দেশে এ সংস্কৃতি এখনো গড়ে ওঠেনি। আমার ৫০ বছরের ব্যবসায়ী জীবনে অনেক সরকারকে দেখেছি। আমরা প্রতিনিয়ত সরকারের সঙ্গে এ বিষয়ে আলাপ করি। কিন্তু সরকার এ বিষয়গুলো প্রকৃতপক্ষে কার্যকর করার মতো ব্যবস্থা নেয়নি।
আমি যখন প্রথম আমদানির জন্য ভ্যাঙ্কুভারে গিয়েছিলাম তখন দেখলাম, তাদের গম সংরক্ষণের জন্য যে ব্যবস্থা, সেটি আমাদের কিংবা সরকারের কারোরই নেই। স্বাধীনতার পর আমাদের কিছুই ছিল না। আমরা বিগত সরকারপ্রধানকে নদী ড্রেজিংয়ের জন্য অনুরোধ করেছিলাম। আগে ১২ কোটি টন পণ্য আসত কিন্তু এখন ১৪ কোটি টন পণ্য আসছে। আমাদের চট্টগ্রাম পোর্টের কোনো সক্ষমতা নেই। ঢাকা-চট্টগ্রাম রোডের মালামাল পরিবহনের সক্ষমতা নেই। আমরা আউটলেট থেকে মালগুলো নিয়ে পাবনা, সিলেট, খুলনা ও মেঘনাঘাটসহ বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করি। এজন্য নদীর নাব্যতা দরকার। এখানে যদি নাব্যতার সমস্যা হয় তাহলে আমরা আবদ্ধ হয়ে পড়ব। আমাদের চট্টগ্রাম পোর্টের পর্যাপ্ত মালামাল রাখার সক্ষমতা নেই। পায়রায় তো জাহাজ যেতেই পারে না। তাই আমাদের পোর্ট ও রোডের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। এসব বিষয় যখন আরো জটিল হয় তখন সরকার সে বিষয়ে দৃষ্টি দেয়। এজন্য প্রত্যেকটি অংশীজন বা সমিতি রয়েছে তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে তাদের সুবিধা-অসুবিধা বোঝা দরকার। সরকার শুল্ক থেকে শুরু করে যেকোনো নীতিনির্ধারণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে গেলে অংশীজনদের আলোচনা করার জন্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। কেননা ব্যবসায়ীদের নানা সমস্যা রয়েছে। এসব সমস্যার উন্নয়নে সরকারকে কাজ করতে হবে। এটি না করতে পারলে সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নয়ন হবে না। অনেকেই অনেক চরাই-উতরাই পার হয়ে উদ্যোক্তা হয়েছেন। আমাদের সরবরাহ ব্যবস্থা ছিল না। সরবরাহ ব্যবস্থা বলতে শুধু চট্টগ্রাম পোর্টে আসত এবং জাহাজ দিয়ে নিয়ে আসতাম। এটির সঙ্গে অনেক কিছু সম্পৃক্ত। সেখানে আবার লোডিং-আনলোডিং, ক্রেন জেটি অনেক কিছু সম্পৃক্ত। এরপর ট্রাকের মাধ্যমে সারা দেশে সরবরাহ করা হয়। আমাদের গোডাউন ছিল না। খাদ্যদ্রব্যের ওয়্যারহাউজগুলো অনেক ব্যয়বহুল। ব্যাংকগুলো ঋণ দেয় না। সরবরাহ ব্যবস্থা যদিও দুটি শব্দের। কিন্তু এর বিশাল ব্যাপকতা আছে। তাই সরবরাহ ব্যবস্থা ঠিক না থাকলে পণ্য থাকলেও আমরা সরবরাহ করতে পারব না। সরবরাহ ব্যবস্থা ঠিক করার জন্য আমাদের অনেক কাজ করতে হবে। সারা দেশে সরকার কিছু গোডাউন করছে। দেশের যেকোনো জায়গায় দুর্যোগ এলে সেখানে ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে সরবরাহ করা যাবে না। এর জন্য সরকার কাজ করছে। গোডাউন আরো বাড়ানোর জন্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
কৃষিপণ্যের দাম অনেক সময় হঠাৎ বেড়ে যায়। এর বিভিন্ন কারণ আছে এবং এর একটি সার্কেল আছে। এজন্য আমাদের সংরক্ষণ ব্যবস্থাকে উন্নত করতে হবে। সেজন্য উদ্যোক্তাদের জন্য সরকারি সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর জন্য নীতিনির্ধারণী ও সহযোগিতার ব্যবস্থা করতে পারে সরকার। এর জন্য সরবরাহ ব্যবস্থা বা নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও পূর্বাভাস উন্নত করতে হবে। আমাদের চাল বা অন্যান্য পণ্য কী পরিমাণ উৎপাদন হবে—সেই পূর্বাভাসের তথ্য যেন সঠিক হয়—সেটিও নিয়ে কাজ করতে হবে। পরিসংখ্যানের তথ্যগুলোও সঠিক হওয়া দরকার। যাতে পূর্বাভাস ও পরিসংখ্যানের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে ব্যবসায়ীরা কাজ করতে পারেন। এগুলো একজন ব্যবসায়ীর পক্ষে করা সম্ভব নয়। এর জন্য দেশের পরিসংখ্যান বিভাগ ও সরকারের অন্যান্য বিভাগের দায়িত্ব। তারা যেন সেটি জনগণকে ব্যাপকভাবে জানাতে পারে সেসব বিষয়ে সরকারকে কাজ করতে হবে।
কৃষিপণ্যের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য আমাদের বিজ্ঞানীরা অনেক উন্নত জাত আবিষ্কার করছেন। আমাদের সারের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। এসব বিষয়ে নিয়ে সরকারকেই উদ্যোগ নিয়ে কাজ করতে হবে।
- ট্যাগ:
- মতামত
- কৃষি উৎপাদন
- পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা