গত বছর মাসাধিককালব্যাপী চলা ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের সাড়ে ১৫ বছরের নির্মম শাসনের পরিসমাপ্তি ঘটলে দেশের মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। দেশ নতুন করে আলোর পথে যাত্রা শুরু করে। নোবেলবিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে। বিগত সরকারের আমলে দেশের অর্থনীতি থেকে শুরু করে প্রতিটি সেক্টর বিপর্যয়ের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছিল। সেই অবস্থা থেকে দেশকে স্বাভাবিক পথে ধাবিত করা ছিল খুবই চ্যালেঞ্জিং।
দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত সমস্যার রাতারাতি সমাধান সম্ভব নয়। তারপরও বিভিন্ন ক্ষেত্রে দৃশ্যমান উন্নতি ও অগ্রগতি লক্ষ করা যাচ্ছে, যা মানুষের মনে আশার সঞ্চার করেছে। বিশেষ করে অর্থনীতি ও পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ক্রমেই উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। আগে পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে একদেশদর্শিতা লক্ষ করা যেত, যা বর্তমানে অনেকটাই দূরীভূত হতে চলেছে। বাংলাদেশ এখন স্বাধীনভাবে তার পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে পারছে। সৌদি আরব বাংলাদেশে একটি তেল শোধনাগার নির্মাণ করতে চাচ্ছে। চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি উন্নতমানের আধুনিক হাসপাতাল নির্মাণ করার চিন্তাভাবনা করছে।
এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) তাদের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, ২০২৪ সালে বাংলাদেশের গ্রস ডমেস্টিক প্রোডাক্টের (জিডিপি) পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৫০ দশমিক ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে অর্থনীতির আকার বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থান হচ্ছে নবম। তবে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আশাব্যঞ্জক উন্নতি না হওয়ার কারণে চলতি অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার কিছুটা হ্রাস পেতে পারে।
এডিবি এর আগে পূর্বাভাস দিয়েছিল, বাংলাদেশ চলতি অর্থবছরে ৪ দশমিক ৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করবে। এখন তা কমিয়ে ৩ দশমিক ৯ শতাংশ করেছে। এ মুহূর্তে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের ইস্যুটি। ইন্টারন্যাশনাল মানিটারি ফান্ড (আইএমএফ) তাদের সর্বশেষ প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এ বছর (২০২৫) মূল্যস্ফীতির হার ১০ শতাংশের উপরে থাকবে।
আবার বিশ্বব্যাংক বলেছে, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে খাদ্য খাতে বর্তমানে যে মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে, তা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ। উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং মন্থর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পেছনে নানা কারণ কাজ করছে। তবে একটি উল্লেখযোগ্য কারণ হচ্ছে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির আশানুরূপ উন্নতি না হওয়া। অতীতে দেখা গেছে, আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তিত হলে কিছুদিন সামাজিক ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি বিরাজ করলেও ত্বরিত স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসে। কিন্তু গত আগস্টে সরকার পরিবর্তিত হওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনো পুরোপুরি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসেনি।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির এ অবনতির জন্য মূলত বিগত সরকারের ভুল নীতিই দায়ী। আওয়ামী লীগ সরকার আমলে পুলিশ বাহিনীকে দলীয় অস্ত্রধারী ক্যাডারের মতো ব্যবহার করা হয়েছে। হেন অপকর্ম নেই, যা পুলিশ দ্বারা করানো হয়নি। সরকারি দলের সমর্থনে অনৈতিক ভূমিকা পালনের কারণে পুলিশের নৈতিক মনোবল এখন শূন্যের কোঠায়। অতীতে একাধিকবার আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তিত হয়েছে। কিন্তু কোনোবারই পুলিশ থানা থেকে পালিয়ে যায়নি। কিন্তু গত বছর আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তিত হলে অধিকাংশ থানা থেকে পুলিশ সদস্যরা পালিয়ে যায়। কোনো কোনো থানায় সেনাসদস্যদের প্রহরায় পুলিশ সদস্যরা দায়িত্ব পালন করেছেন। এখনো পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের অনেকেই দূরবর্তী স্থানে অভিযানে যেতে ভয় পান। সার্বিকভাবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির জন্য পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের নিষ্ক্রিয়তা অনেকাংশে দায়ী। পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের অনেকেই সঠিকভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করছেন না। দেশে বিভিন্ন বাহিনী থাকলেও সামাজিক অপরাধ দমনের ক্ষেত্রে পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের কোনো বিকল্প নেই। পুলিশ বাহিনীই একমাত্র সংগঠন, যারা তৃণমূল পর্যায়ের অপরাধীদের সম্পর্কে খোঁজখবর রাখে।