
পাকিস্তানের রাজনীতি: সামরিক আধিপত্য ও বেলুচিস্তানের সংগ্রাম
দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি রাষ্ট্র পাকিস্তান, যার রাজনৈতিক পরিস্থিতি নানা কারণে জটিল। পরমাণবিক শক্তিধর দেশ হিসেবে পাকিস্তান শুধু আঞ্চলিক নিরাপত্তাই নয়, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখে। তবে, দেশটির রাজনৈতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বেসামরিক সরকারগুলো কখনোই পূর্ণ স্বাধীনতা বা কর্তৃত্ব উপভোগ করতে পারেনি সেখানে। এর প্রধান কারণ সামরিক বাহিনীর ব্যাপক প্রাতিষ্ঠানিক প্রভাব। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী কেবল জাতীয় নিরাপত্তার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং রাজনীতি, অর্থনীতি এবং কূটনীতিতেও শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে।
পাকিস্তানের সরকার ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি
সংবিধান অনুযায়ী পাকিস্তান একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। কিন্তু বাস্তবে, সামরিক বাহিনীর প্রভাবের কারণে দেশটির রাজনীতিতে অস্থিরতা ও অস্থিতিশীলতা একটি ধারাবাহিক বৈশিষ্ট্য। এই পরিস্থিতি দেশটির গণতন্ত্রকে দুর্বল করেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দল, দুর্নীতির অভিযোগ এবং সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ হস্তক্ষেপ নির্বাচনের স্বচ্ছতা ও কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। ইমরান খানের নেতৃত্বাধীন সরকার পতনের পর থেকে দেশের রাজনীতি আরও বিভক্ত ও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
এছাড়া, বেলুচিস্তানে স্বাধীনতা সংগ্রাম, সিন্ধু নদীর পানি বণ্টন এবং চোলিস্তান ক্যানাল প্রকল্প নিয়ে বিতর্ক, কাশ্মীর ইস্যুতে ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্ব, দুর্বল অর্থনীতি, মুদ্রাস্ফীতি, জ্বালানি সংকট এবং আন্তর্জাতিক ঋণের চাপ সরকারের জন্য নানামুখী চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে। ফলে জনগণের মধ্যে আস্থাহীনতা ও সামাজিক অসন্তোষ ক্রমশ বাড়ছে।
পাকিস্তানের রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর প্রভাব
পাকিস্তানের ইতিহাসে বেশ কয়েকবার সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সেনাবাহিনী সরাসরি ক্ষমতা দখল করেছে। ১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খানের অভ্যুত্থানের মাধ্যমে এই প্রবণতা শুরু হয়। ১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খানের (১৯৫৮-১৯৬৯) অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এই প্রবণতা শুরু হয়। পরবর্তীতে আরও তিনটি উল্লেখযোগ্য সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে।
জেনারেল ইয়াহিয়া খান (১৯৬৯-১৯৭১) পূর্ব পাকিস্তানের সংকট মোকাবিলায় ব্যর্থ হন, যার পরিণতিতে বাংলাদেশ জন্ম নেয়। জেনারেল জিয়াউল হক (১৯৭৭–১৯৮৮) জুলফিকার আলী ভুট্টোর সরকার উৎখাত করে ইসলামিক শাসন পদ্ধতি চালু করেন। জেনারেল পারভেজ মোশাররফ (১৯৯৯-২০০৮) এক রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানে প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফকে অপসারণ করে নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে দশ বছর দেশ শাসন করেন।
এমনকি গণতান্ত্রিক শাসনকালেও সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা (আইএসআই) এবং সেনাপ্রধানরা রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেন। সামরিক বাহিনীকে প্রায়শই ‘রাষ্ট্রের মধ্যে আরেকটি রাষ্ট্র’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারগুলো প্রায়শই সেনাবাহিনীর অনুমোদন ছাড়া নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে অক্ষম।
পাকিস্তানের ‘ডিপ স্টেট’
সামরিক বাহিনী বর্তমানে সরাসরি ক্ষমতায় না থাকলেও ‘ডিপ স্টেট’ বা অপ্রকাশ্য রাষ্ট্রের মাধ্যমে তাদের প্রভাব অব্যাহত রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০২২-২৩ সালে ইমরান খানকে ক্ষমতা থেকে সরানোর ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর ভূমিকা স্পষ্ট ছিল। নির্বাচনি প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ, নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে বিচারব্যবস্থার ব্যবহার এবং গণমাধ্যমের ওপর সেন্সরশিপের অভিযোগ সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার বিরুদ্ধে উঠেছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে পিটিআই-এর উত্থানেও সেনাবাহিনীর ভূমিকা ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।
এছাড়াও, গণমাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণ, সাংবাদিকদের গুম, নির্যাতন এবং ভয়ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগও দীর্ঘদিনের। জিও টিভি, ডন এবং অন্যান্য গণমাধ্যমের ওপর সরাসরি ও পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ রয়েছে। বেলুচিস্তান, খাইবার পাখতুনখাওয়া এবং সিন্ধুতে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের জন্য সেনাবাহিনী ও আইএসআই দায়ী বলে মানবাধিকার সংস্থাগুলোর দাবি।