
আশায় আশায় বসে আছি
না, কারও আসার আশায় নয়। কিংবা কারও টেলিফোন আসবে—এমন আশাও করি না। বসে আছি একটা পরিবর্তনের প্রত্যাশায়। সেটি কোনো কাগুজে পরিবর্তন নয়। একটা প্রকৃত অর্থবহ পরিবর্তন চাই। এই যে এত বড় একটা অভ্যুত্থান হলো, তার ফলস্বরূপ একটা পরিবর্তন দরকার। রাষ্ট্র, রাজনীতি তথা সমগ্র আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থাকে গণমুখী ও জনবান্ধব করার মতো একটা পরিবর্তন। দেশে আইনের শাসন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মতো একটা পরিবর্তন।
এমন একটা পরিবর্তনের আশা তো সবাই করেছিল। এখন থেকে মাত্র আট-নয় মাস আগে। গত বছরের জুলাই-আগস্টে। ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব সেই অভ্যুত্থানের সময়। কিন্তু সে আশা কতটা পূরণ হতে পারে, সে বিষয়ে এরই মধ্যে জনমনে যথেষ্ট সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে। কারণ, সাধারণ মানুষের কাঙ্ক্ষিত ওই পরিবর্তনের প্রশ্নে অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক শক্তিগুলোর মধ্যেকার মতদ্বৈধতা ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। এমনই সে মতদ্বৈধতা যে তা কোনোভাবেই ঘুচবার নয় বলে মনে হয়।
গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর অভ্যুত্থানের সামনের সারির শক্তি (স্ট্রাইকিং ফোর্স) ছাত্র নেতৃত্বের এবং সরকারের মূল লক্ষ্য হয় রাষ্ট্রব্যবস্থার আমূল সংস্কার, গণহত্যার জন্য শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের বিচার এবং রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা।
সেই অবস্থায় সরকার ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করে কাজ শুরু করে। পাশাপাশি ছাত্র নেতৃত্ব সংস্কারের স্বপ্নে এতটাই বিভোর হয়ে পড়ে যে তাঁরা একাত্তর, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, বাহাত্তরের সংবিধানের মতো মৌলিক বিষয়গুলোকেও প্রায় নাকচ করে দিতে থাকেন। তাঁরা এমন এক বয়ান তৈরি করেন, যার মূল কথা হলো অতীতের সবকিছুই ভুল ছিল। একমাত্র ঠিক হচ্ছে ২০২৪। অবশ্য অল্প দিনের মধ্যেই ছাত্রনেতাদের মধ্য থেকে ভিন্ন বয়ানও আসতে থাকে।
ওই সময় জামায়াতে ইসলামী একাত্তর ও মুক্তিযুদ্ধকে ভুল রাজনৈতিক পদক্ষেপ ও ঘটনা হিসেবে হাজির করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে, যাতে তারা একাত্তরে তাদের ভূমিকার একটা গ্রহণযোগ্য বয়ান তৈরি করতে পারে। এই কারণে ছাত্র নেতৃত্বের সঙ্গে জামায়াতের বয়ানের এবং রাজনৈতিক অবস্থানের একটা সাদৃশ্য দেখা যায়। এই সাদৃশ্য রাষ্ট্র সংস্কার থেকে নির্বাচনের সম্ভাব্য সময়ের প্রশ্নেও বহাল ছিল।
এর পাশাপাশি আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে দেশের সবচেয়ে বড় ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দল বিএনপির লক্ষ্য নির্ধারিত হয় যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন অনুষ্ঠান। সেই লক্ষ্যে তারা শুরু থেকেই নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট পথনকশা দেওয়ার জন্য সরকারের ওপর চাপ দিতে থাকে। ফলে অভ্যুত্থানের প্রধান তিনটি শক্তির মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। এর মধ্যে সম্প্রতি বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যেকার দূরত্ব কিছুটা ঘুচেছে বলে লক্ষ করা যাচ্ছে। জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমানের ইউরোপ সফরকালে লন্ডনে গিয়ে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ কারণে নির্বাচনের সময়সূচির বিষয়ে দল দুটির অবস্থান কাছাকাছি এসেছে।
এর আগে বিএনপি এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবি জানিয়ে এসেছে। কিন্তু জামায়াত সব সময় বলে এসেছে যে তারা সংস্কারের জন্য সরকারকে সময় দিতে চায়। নির্বাচনের সময় নিয়ে সরকারকে তারা চাপ দিতে চায় না। তবে লন্ডন থেকে ফেরার পর জামায়াতের আমির বলেন, তাঁরা মনে করেন আগামী বছরের ঈদুল ফিতরের আগে নির্বাচন হওয়া উচিত। অর্থাৎ ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে। এরপর কয়েক দিন আগে গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন হলে বিএনপি আপত্তি করবে না। এই ঘটনায় একটি বিষয় স্পষ্ট হতে শুরু করেছে যে নির্বাচনী রাজনীতিতে বিএনপি ও জামায়াত কাছাকাছি থাকার সুযোগ পেলে তা হাতছাড়া করবে না। তাতে দুই দলেরই স্বার্থ রয়েছে। তবে সংস্কার, স্বৈরশাসকদের বিচার, নির্বাচন—এসব বিষয়ে ছাত্রদের গঠিত দল এনসিপির অবস্থান আগের মতোই আছে।
অভ্যুত্থানের প্রধান তিনটি শক্তির মধ্যেকার এই রাজনৈতিক মতদ্বৈধতার ফলে দেশের বিরাজমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ভালো রকমের অস্থিতিশীলতা রয়েছে। এই সময়কালে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে কিছু অশুভ শক্তিরও উত্থান ঘটেছে বলে পর্যবেক্ষকদের অভিমত। তাদের মূল লক্ষ্য অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে ফায়দা লোটা। এই শক্তির কারণে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে অনিশ্চয়তাও রয়েছে। এই রাজনৈতিক বাস্তবতায় এনসিপির আগে সংস্কার পরে নির্বাচন, সংসদের সঙ্গেই গণপরিষদের নির্বাচন, বাহাত্তরের সংবিধান বাতিল, নতুন সংবিধান প্রণয়ন এবং জুলাই ঘোষণা সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা প্রভৃতি দাবি নিয়ে কতটা অগ্রসর হতে পারবে, সে বিষয়ে সন্দেহের যথেষ্ট কারণ আছে।