
স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ আশা করেছিল, দেশ লুণ্ঠন, চাঁদাবাজি, অর্থ পাচারের মতো অপকর্ম থেকে মুক্তি পাবে। গণপ্রত্যাশা অনুযায়ী দেশে ব্যাংক থেকে অবৈধভাবে অর্থ লুট বন্ধ হয়ে গেছে, বন্ধ হয়ে গেছে অবৈধভাবে লুট করে বিদেশে অর্থ পাচারের প্রক্রিয়াও। বরং সরকার এখন স্বৈরাচারী আমলের অবৈধভাবে আত্মসাৎ করা সম্পদ পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছে বিভিন্নভাবে। দেশের জনগণ সরকারের এসব প্রচেষ্টার সাফল্য কামনা করে সর্বান্তকরণে। কিন্তু দেশের চাঁদাবাজিটা বন্ধ করা সম্ভব হয়নি।
স্বৈরাচারী আমলে আওয়ামী লীগ চাঁদাবাজিটাকে একটি স্ট্রাকচারড পদ্ধতির মধ্যে নিয়ে গিয়েছিল। লঞ্চ ও বাস টার্মিনালে, সরকারি চাকরিতে নিয়োগ ও বদলিতে, জমির দখল বুঝে নিতে গেলে, টেন্ডারের মাধ্যমে নতুন ভবন নির্মাণসহ দেশের বিভিন্ন করপোরেশন ও অধিদপ্তরের মাধ্যমে দেশের নানা উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন ইত্যাদিতে চাঁদাবাজিকে প্রায় প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করা হয়েছিল। ফলে এসব কাজে সংশ্লিষ্ট হওয়ার আগেই আগ্রহী ব্যক্তিরা জেনে যেতেন কত টাকার কাজে কত টাকা ঘুস দিতে হবে। কেউ কোনো উচ্চবাচ্য করতেন না। কাজ হোক বা না হোক, টাকার লেনদেনটা ঠিকই হয়ে যেত সময়মতো। চমৎকার ব্যবস্থা। আর প্রাক্কলিত ব্যয়ও সেভাবেই নির্ধারণ করা হতো, যাতে ‘ঘুসদাতা’ ও ‘ঘুসখোর’ উভয়ই পর্যাপ্তভাবে লাভবান হতে পারেন। ক্ষতিটা হতো শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের, যাদের প্রতিবাদ করার ক্ষমতা ছিল না বা নাই। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, ঢাকা মহানগরীর ‘মৌচাক-সাতরাস্তা’ ফ্লাইওভারের মূল প্রাক্কলিত ব্যয় ২৫০ কোটি টাকা থাকলেও পঞ্চম সংশোধনীতে তা গিয়ে দাঁড়ায় ১২৫০ কোটি টাকায়। পরে ওই কাজ বাবদ কত টাকা পরিশোধ হয়েছে, তা আল্লাহ মালুম। বর্তমানে কি এ ঘুস বাণিজ্য বন্ধ হয়েছে? হলে উন্নয়ন কাজের প্রাক্কলিত ব্যয় তো প্রচুর পরিমাণে কমে আসার কথা। কিন্তু সে রকম কোনো সংবাদ তো চোখে পড়ছে না। বস্তুত এসব স্থানে কিছু ক্ষেত্রে ঠিকাদার বদল হয়েছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরোনো ঠিকাদাররাই নতুন রাজনৈতিক সহযোগী নিয়ে কাজ করছেন। ফলে সিস্টেমটা অক্ষতই রয়ে গেছে।
বর্তমানে প্রতিনিয়ত যে চাঁদাবাজির অভিযোগ শুনছি, সেটা আসছে মূলত বাস ও ট্রাক স্ট্যান্ডগুলো থেকে। এছাড়া দরিদ্র টেম্পো স্ট্যান্ড চালক/শ্রমিক, কাঁচা বাজার ও ফুটপাথের তরিতরকারি ও ফল ব্যবসায়ীদের কাছ থেকেও চাঁদাবাজির সংবাদ আসছে। এ হতদরিদ্র মানুষগুলো চিরদিনই এলাকার সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজ রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক মানুষদের চাঁদা দিতে বাধ্য হয়েছে। আর পুলিশের একটা অংশের উৎপাতের কথা তো বলার অপেক্ষাই রাখে না। সারা দিনে ৩০০/৫০০ টাকা উপার্জন করে ৫০-১০০ টাকা চাঁদা দেওয়ার চেয়ে কঠিন কাজ আর নেই। সে কারণে এ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ছিল স্বৈরাচারী আওয়ামী সরকারের ওপর এবং তারা গত গণ-অভ্যুত্থানে জীবন বাজি রেখে লড়াই করেছে স্বৈরাচারের সন্ত্রাসী, পুলিশ/বিজিবির বিরুদ্ধে। গত গণঅভ্যুত্থানে নিহত ও আহতদের তালিকা দেখলেই এ বিষয়টি পরিষ্কার হবে। এ হতদরিদ্র মানুষের আকাঙ্ক্ষা কিন্তু ‘উপদেষ্টা’ হয়ে দেশ শাসন করা বা চাঁদাবাজি ও দল গঠন করে রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়া না। তাদের দাবি খুব সামান্য, চাঁদা দেওয়া ছাড়াই ছোটখাটো ব্যবসা করে নিজের ও পরিবারের ভরণপোষণ করা। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো, ক্ষমতার পট পরিবর্তন হলেও নতুন আরেক দল সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজ পুরোনোদের স্থান দখল করে নেয় এবং চাঁদার হার বাড়িয়ে দিয়ে চাঁদাবাজি অব্যাহত রাখে।
এ কথা অনস্বীকার্য, যে কোনো লোককেই দীর্ঘমেয়াদে চাঁদাবাজি করতে হলে তাকে কোনো একটি রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় থাকতে হয়। নাহলে পুলিশ বা অন্য সংগঠনের লোকজন তাকে তাড়িয়ে দেয়। সে কারণে দেশের যে কোনো বা সব চাঁদাবাজকে জিজ্ঞেস করলে জানা যায়, সে অমুক বা তমুক দলের সদস্য বা অমুক ভাইয়ের লোক। সংশ্লিষ্ট ওই দলের নেতাই এ অবৈধ চাঁদার টাকাটা পান; আর যারা চাঁদা তোলে, তারা মূলত দৈনিক বা মাসিক ভিত্তিতে নিয়োজিত শ্রমিক।
- ট্যাগ:
- মতামত
- চাঁদাবাজি
- আইনগত ব্যবস্থা