
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ আসলেই শেষ হয়নি
বাংলাদেশে মৌলবাদ আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এক দিক দিয়ে এটা অত্যন্ত অপ্রত্যাশিত। কেননা বাংলাদেশের অভ্যুদয় ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে প্রত্যাখ্যান ও পরাভূত করে। কিন্তু পরাভূত শক্তি আবার ফিরে এসেছে। তার পরাজয়টা কেবল যে সশস্ত্র যুদ্ধক্ষেত্রে ঘটেছিল তা নয়, ঘটেছিল আদর্শিকভাবেও। তাহলে কেন তার পুনরুত্থান? কেমন করে?
বোঝা যায় যে মৌলবাদীরা তাদের আদর্শিক পরাজয়টিকে মেনে নেয়নি। দৈহিকভাবে হেরে গিয়ে এবং ধাওয়া খেয়ে পালিয়ে ছিল মাত্র, পরে পরিস্থিতি আগের মতো প্রতিকূল নেই দেখে ফিরে এসেছে। এই যে পরিস্থিতি পাল্টে যাওয়া, এর প্রধান উপাদান কী? সেটা হলো পুঁজিবাদের পুনঃপ্রতিষ্ঠা। ওই যে ব্যক্তি বড় হয়ে উঠছে সমষ্টির তুলনায়—এই নীতিটি আগের রাষ্ট্রগুলোতে কার্যকর ছিল, মনে হয়েছিল বাংলাদেশে তা থাকবে না, কেননা বাংলাদেশ হবে প্রকৃত অর্থে গণতান্ত্রিক, সেখানে রাষ্ট্র হবে সবার সাধারণ সম্পত্তি, যার দরুন রাষ্ট্র তার শোষণকারী ভূমিকা ছেড়ে রক্ষাকারীর ভূমিকা নেবে এবং সমাজে অধিকার ও সুযোগের সাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে। সেটাই ছিল স্বপ্ন। স্বপ্ন ভেঙে গেছে। যার ফলে অধিকাংশ মানুষের জীবনে দুঃস্বপ্ন নেমে এসেছে, এমন দুঃস্বপ্ন যা ছিল কল্পনার বাইরে, কারণ মুক্তিযুদ্ধে বিজয় তাদেরকে আশা দিয়েছিল, ভাববার সাহস জুগিয়েছিল যে স্বপ্ন দূরে নয়, নিকটবর্তী বটে।
চোখ কচলে মানুষ দেখেছে যে যুদ্ধ করল সবাই, কিন্তু সুফল চলে যাচ্ছে ধনীদের গৃহে। উনিশ শ সাতচল্লিশের স্বাধীনতাতে যারা উপকৃত হয়েছিল, একাত্তরের স্বাধীনতাতে তারাই উপকার পাচ্ছে, দ্বিতীয়বার। কে মুক্তিযোদ্ধা আর কে রাজাকার সেটা কোনো বিবেচনার বিষয় রইল না, সত্য হয়ে উঠল শ্রেণি। সাধারণ মানুষ আরও দেখল মুক্তিযোদ্ধা নাম নিয়ে কিছু মানুষ এমন আচরণ করছে যে তারা যেন পাকিস্তানিদের পরাজিত করেনি, যেন নিজেদের দেশকেই জয় করেছে; কাজেই দেশ তাদের, তারা এখন লুটপাট করবে, আগে পাকিস্তানিরা যেমন লুটপাট করেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সর্বত্র ভূলুণ্ঠিত হলো।
রাষ্ট্র আবার সেই পুরোনো পুঁজিবাদী পথ ধরে এগোতে থাকল। সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বিদায় নিল, সমাজতন্ত্রকে ছেঁটে ফেলা হলো এবং গণতন্ত্রের পরিবর্তে কখনো বৈধ কখনো অবৈধ স্বৈরশাসন কায়েমি হয়ে বসে রইল। দারিদ্র্য, বৈষম্য ও অজ্ঞতা বৃদ্ধি পাওয়া শুরু করল। অধিকাংশের স্বার্থ না দেখে কতিপয়ের স্বার্থ রক্ষা করবার দায়িত্ব গ্রহণ করে রাষ্ট্র হয়ে দাঁড়াল পীড়নকারী প্রতিষ্ঠান, যার কাছে আশ্রয় নেই, ভরসা নেই ন্যায়বিচারের।
কথা ছিল শিক্ষা হবে অভিন্ন ও সর্বজনীন। তা হয়নি। পাকিস্তানি রাষ্ট্রে এবং তারও আগে যে তিন ধরনের শিক্ষাধারা প্রচলিত ছিল, সেগুলো প্রবল বেগে ফিরে এসেছে। গরিব মানুষকে উৎসাহিত করা হয়েছে মাদ্রাসায় সন্তানদের পাঠাতে। সেখানে গিয়ে তারা আরও গরিব হয়েছে এবং ধর্মনিরপেক্ষতায় আস্থা হারিয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে শাসকশ্রেণির অস্বস্তি ছিল। ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে তারা সব ধর্মের অবাধ চর্চা বুঝেছে এবং কার্যত ধর্মচর্চাকে উৎসাহিত করেছে।
এটাও দেখা গেছে, ধনীরা মনে করেছে যে তারা ধনী হয়েছে ভাগ্যগুণে। তারা আরও ধনী হতে চায়। আবার ভেতরে-ভেতরে অপরাধবোধও কাজ করেছে, কেননা তারা জানে যে ধনার্জনের পথটা যে সৎ ছিল তা নয়, ছিল অপরাধাচ্ছন্ন। সৌভাগ্যের অত্যাশ্চর্য তৎপরতার জন্য কৃতজ্ঞতা এবং অপরাধবোধের বোঝা এই দুইয়ের তাড়নায় ধনীরা ধর্মকার্য ধরেছে। তারা মোটেই ধার্মিক নয়, ধর্মের আনুষ্ঠানিকতাটাই করে, আধ্যাত্মিকতার বালাই নেই। কিন্তু তাদের দৃষ্টান্ত কম বিত্তবানদের অস্থির করে ধর্মের পথ ধরতে।
সমাজের প্রায় সবাই এখন পুঁজিবাদী। ব্যক্তিগত মুনাফা চায়। অন্যের ভালোমন্দ সম্পর্কে আগ্রহ কমছে, ক্রমাগত সংকীর্ণ, স্বার্থবুদ্ধিসর্বস্ব ও হতাশ হয়ে পড়ছে। হতাশা একটি ভয়ংকর ব্যাধি। ধর্মসহ নানাবিধ মাদকাসক্তি ওই ভূমিতে লালিত-পালিত হয়।
প্রতিশ্রুতি ছিল যে রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষতাকে প্রতিষ্ঠিত করবে। রাষ্ট্র তা করেনি। বস্তুত রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষতাকে কেবল যে সংবিধান থেকে বাদ দিয়েছে তা নয়, সেখানে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে যুক্ত করেছে। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের তৎপরতা তো রয়েছেই, জাতীয়তাবাদী বলে পরিচিত বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলও প্রায় প্রতিযোগিতামূলক পদ্ধতিতেই ধর্মকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে চলেছে।