
অতি উৎসাহীদের থামাতে হবে এখনই
একজন গৃহবধূ। তিনি সংসার খরচের টাকা বাঁচিয়ে ১৫ বছর আগে শুরু করলেন তিন হাজার টাকার একটি সঞ্চয় স্কিম। প্রতি মাসে তিন হাজার টাকা করে জমা দেন। একসময় তিনি চিন্তা করলেন তাঁর মেয়ে বড় হচ্ছে, তার ভবিষ্যতের জন্য কিছু করা দরকার।
এ জন্য তিনি বিভিন্ন রান্না পরিচিতজনের কাছে বিক্রি করা শুরু করলেন। হাতের কাজও তিনি ভালো পারেন। রান্নার কাজে যখন তিনি দেখলেন যে ভালোই টাকা পয়সা উপার্জন করা যায়, তখন তিনি হাতের কাজে মনোযোগী হলেন। এভাবে তাঁর একদিকে যেমন পরিচিত বাড়ল, তেমনি উপার্জনের একটা ভালো পথ তৈরি হলো।
সংসার খরচের জন্য তিনি এই উপার্জনগুলো ব্যবহার করলেন না, বরং ব্যবহার করলেন ভবিষ্যতের সঞ্চয়ের জন্য। মধ্যবিত্তের জন্য সঞ্চয়ের একমাত্র পথ হলো ব্যাংকে টাকা রাখা। তিনি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র যেমন পাঁচ হাজার, ১০ হাজার টাকার ছোট ছোট সঞ্চয় স্কিম বা ডিপোজিট স্কিমের মাধ্যমে সঞ্চয় করতে শুরু করলেন। যখনই একটা ডিপিএস মেয়াদ পূর্ণ করে তখন তিনি সেই টাকাটা তুলে খরচ করেন না।
বরং সেই টাকা স্থায়ী আমানত হিসাবে ওই ব্যাংকে জমা রাখেন। এভাবে করতে করতে তাঁর বেশ কিছু স্থায়ী আমানত তৈরি হলো। উপার্জনের টাকায় তিনি তাঁর ডিপিএসগুলো অব্যাহত রাখতে থাকলেন। এক পর্যায়ে তাঁর মোটামুটি ভালো একটা সঞ্চয় হলো। কিন্তু তখন শুরু হলো এক অনাকাঙ্ক্ষিত উদ্ভট বিড়ম্বনা।
হঠাৎ তিনি জানলেন যে তাঁর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করে দেওয়া হয়েছে। তাঁর ডিপিএস এবং স্থায়ী আমানত সব স্থগিত রাখা হয়েছে। ছুটে গেলেন তিনি ব্যাংকে। যেখানে তাঁর সারা জীবনের সঞ্চয় গচ্ছিত রয়েছে। ব্যাংক বলল, বাংলাদেশ ফিন্যানশিয়্যাল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) তাঁর ব্যাংকের হিসাবগুলোকে জব্দ করেছে। কারণ তারা মনে করছে একজন গৃহবধূ হিসেবে এত টাকা জমা হয় কিভাবে। এ ব্যাপারে তদন্ত হচ্ছে। তদন্তের পর তাঁকে জানানো হবে। এক মাস যায়, দুই মাস যায়। তিনি একদিকে যেমন তাঁর ডিপিএসের জন্য প্রতি মাসে টাকা দিতে পারছেন না, অন্যদিকে তাঁর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে টাকাও তুলতে পারছেন না। এর মধ্যে তিনি স্থায়ী আমানতের বিপরীতে ঋণ নিয়েছিলেন। সেই ঋণের কিস্তিও পরিশোধ করতে পারছেন না। ফলে ঋণের বিপরীত সুদের বোঝা বড় হচ্ছে। ভদ্র মহিলার চোখে-মুখে অন্ধকার অনিশ্চয়তা। অনন্যোপায় হয়ে তিনি একজন আইনজীবীর পরামর্শ নিলেন। বাধ্য হয়ে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে রিট আবেদন করলেন। হাইকোর্টে শুনানি হলো। সব কিছু দেখে আদালতও বিস্মিত হতবাক।
কোর্ট নির্দেশ দিলেন বিএফআইইউ যে তাঁর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করেছে তা আইনবহির্ভূত। অবিলম্বে তা খুলে দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হলো। এই নির্দেশের কাগজ নিয়ে ভদ্র মহিলা ছুটলেন আবার ব্যাংকে। ব্যাংক বলল, বিএফআইইউ যতক্ষণ না বলবে তখন তারা খুলতে পারবে না। অর্থাৎ আদালতের নির্দেশও তারা মানবে না। এরপর তিনি বিএফআইইউয়ে জমা দিলেন আদালতের রায়। হঠাৎ একদিন তাঁর আইনজীবী জানালেন যে বিএফআইইউ হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করেছে। মাত্র কিছু টাকার জন্য বিএফআইইউ এত মরিয়া হলো কেন? এ নিয়ে যেমন মহিলা বিভ্রান্ত তেমনি হতবাক আদালতও। এখন প্রশ্ন হলো যে বিএফআইইউ একজন গৃহবধূ মহিলাকে নিয়ে এ রকম ঘটনা কেন করছে? এটা কি সরকারের নির্দেশ নাকি অতি উৎসাহীরা সরকারকে অজনপ্রিয় করতে করছে?
ড. মুহাম্মদ ইউনূস শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন নারীর ক্ষমতায়নের জন্য। গ্রামীণ মহিলারা যেন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের মাধ্যমে আত্মমর্যাদায় বলীয়ান হন। ড. ইউনূস দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলাদেশে শুধু গ্রামে নয়, শহরেও এখন ছোট ছোট হোমমেকার তৈরি হয়েছে। যাঁরা বাড়িতে বিভিন্ন ধরনের হাতের কাজ, রান্না, সেলাই ইত্যাদি করে ভালো উপার্জন করেন। এখন যদি বিএফআইইউ এসব ব্যক্তিদের হয়রানি শুরু করে, তাহলে কি নারীরা সঞ্চয় করতে পারবে? বিএফআইইউ তার অভিযোগে বলেছে, একজন গৃহবধূর অ্যাকাউন্টে এত টাকা থাকে কিভাবে? কিন্তু বিএফআইইউ কি জানে বাংলাদেশের নারীদের সক্ষমতা? ড. ইউনূস বাংলাদেশের নারীদের কিভাবে বদলে দিয়েছেন?
এই ছোট্ট ঘটনাটি উল্লেখ করলাম ৫ আগস্টের পর অতি উৎসাহী কোনো কোনো মহলের বাড়াবাড়ির দৃষ্টান্ত হিসেবে। গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগের শাসনামলে যেমন অতি উৎসাহী, চাটুকার কিছু সরকারি কর্মকর্তা, আমলা তৈরি হয়েছিল, যারা সরকারকে ভুল পথে পরিচালিত করেছিল নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য। এখন আবার একই রকম কিছু উৎসাহী গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে। এদের বাড়াবাড়ির কারণে সাধারণ মানুষের হয়রানি হচ্ছে। সরকার সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হচ্ছে।
ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের অবস্থান খুব সুস্পষ্ট। এই সরকার চাইছে যাঁরা অর্থ পাচার করেছে, যাঁরা দুর্নীতিবাজ, যাঁরা ফ্যাসিবাদের দোসর হিসেবে কাজ করে অনৈতিক পন্থায় বিত্তবৈভবের পাহাড় গড়েছেন তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে। কিন্তু বিএফআইইউ যেন এটিকে এখন মানুষকে হয়রানি করার এক মিশন হিসেবে নিয়েছে। আমরা দেখছি বিভিন্ন বড় বড় শিল্প গ্রুপের ব্যক্তিদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হয়েছে অকারণে, স্রেফ হয়রানি করার জন্য। তদন্তের নামে সময়ক্ষেপণ করা হচ্ছে। ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যে একটা স্থবিরতা নেমে এসেছে। বেসরকারি খাতে রীতিমতো আতঙ্ক বিরাজ করছে। শুধু তা-ই নয়, আমরা দেখছি বিভিন্ন ক্ষেত্রে অতি উৎসাহীরা নানা রকম ষড়যন্ত্রের ডালপালা বিস্তার করেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, ‘প্রশাসন এখন বিএনপির পক্ষে কাজ করছে।’ তিনি যে পুরোপুরি বিষয়টি ভুল বলেছেন এমন নয়। এই প্রশাসনের রদবদলে ছাত্রদের একটা ভূমিকা ছিল। ছাত্ররা যাচাই-বাছাই করে যারা ফ্যাসিবাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল না তাদের বিভিন্ন জায়গায় পদায়ন করেছে। এ ক্ষেত্রে তাদের মতামত ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু যখন আমলারা বিভিন্ন চেয়ারে বসেছেন, তাঁরা মনে করছেন যে আগামী নির্বাচনে হয়তো বিএনপি ক্ষমতায় আসবে। এ জন্য তাঁরা বিএনপির পক্ষে কাজ করার চেষ্টা করছেন। নিজেরা বড় বিএনপি সাজার চেষ্টা করছেন। এতে বিএনপির কোনো লাভ হচ্ছে না, বরং ক্ষতি হচ্ছে। আমি নিশ্চিত, বিএনপির কোনো নেতাই প্রশাসনের কোনো কর্মকর্তাকেই তাদের পক্ষে কাজ করতে বলেনি। যাঁরা করছে তাঁরা সুবিধাবাদী, নব্য চাটুকার।
- ট্যাগ:
- মতামত
- সঞ্চয় স্কিম