
ইতিহাসের ঘটনাবহুল আগস্ট মাস
আগস্ট মাসটি আমাদের জন্য খুবই প্রাসঙ্গিক ও তাৎপর্যপূর্ণ একটি মাস। আমাদের ভূখণ্ডে এই আগস্টে ঘটেছে ইতিহাসের নানা ঘটনা-দুর্ঘটনা। কিশোর বয়সে ১৪ আগস্টে আমরা উদ্যাপন করতাম পাকিস্তান রাষ্ট্রের স্বাধীনতা দিবস। বাড়ির ছাদে পাকিস্তানের পতাকা উড়িয়ে এবং কাগজের পতাকা রশিতে লাগিয়ে, পতাকাদণ্ডের চারপাশে লাগিয়ে, দণ্ডের মাথায় লাইট জ্বালিয়ে কারটি বেশি আকর্ষণীয় হয়েছে, সেটা নিয়ে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতাম। সরকারি ছুটির পরও স্কুলের মিলাদে অংশ নিতাম, স্কুল কর্তৃক নির্দেশিত পায়জামা, পাঞ্জাবি ও টুপি পরে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের সংহতি ও অখণ্ডতা রক্ষার জন্য মোনাজাত করতেন মৌলভি স্যার এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্রের প্রতি ঘৃণা-বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্য রাখতেন মোনাজাতে! ১৯৬৫ সালের পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধের পর প্রতিবেশী রাষ্ট্রকে শত্রুরাষ্ট্র হিসেবে সর্বক্ষেত্রে প্রচার-প্রচারণা করা হতো। আমাদের অংশগ্রহণের মূল আকর্ষণ ছিল মিষ্টির ঠোঙার প্রতি। মোনাজাত শেষে ওটি পাবার আশায় দলবেঁধে যেতাম এবং মিষ্টির ঠোঙা হাতে নিয়ে ফিরতাম। ওই দিন হাইকোর্ট, কার্জন হলসহ বিভিন্ন স্থাপনার আলোকসজ্জা দেখতে যেতাম রাতে ঘোড়ার গাড়িতে চেপে। দিনটি উৎসব হিসেবে দেশের সর্বত্র পালিত হতো রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়।
১৯৪৭-এর ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের এবং ১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা এসেছিল ভ্রাতৃপ্রতিম দুই সম্প্রদায়ের রক্তাক্ত দাঙ্গায়। ভারতবর্ষকে দ্বিখণ্ডিত করে অনুগত কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের কাছে ডমিনিয়ন স্ট্যাটাসের স্বাধীনতা দিয়ে নিরাপদে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ বিদায় নিয়েছিল ১৯০ বছরের শোষণ, লুণ্ঠন, নৃশংস দৃষ্টান্তে বিনা বিচারে দাতার বেশে। সাতচল্লিশের স্বাধীনতা প্রকৃত অর্থে দেশ দুটির সমষ্টিগত মানুষকে যেমন দিতে পারেনি স্বাধীনতা, তেমনি মুক্তিও।
১৯৪৬-এর ১৬ আগস্ট মুসলিম লীগের আহ্বানে ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে পালনকে কেন্দ্র করে কলকাতায় দাঙ্গার সূত্রপাত ঘটে। ওই দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে ভারতব্যাপী। তখনকার বাংলার প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী ওই দিন রাজ্যজুড়ে ছুটি ঘোষণা করেন। ফলে দাঙ্গার সমস্ত দায় বর্তায় সোহরাওয়ার্দীর ওপর। কলকাতা দাঙ্গাই দেশভাগকে অনিবার্য করে তুলেছিল। প্রত্যক্ষদর্শী আমার বাবার কাছে শুনেছি কলকাতা দাঙ্গায় বাঙালি হিন্দু ও মুসলমান তেমন অংশ নেয়নি। বরং একে অপরকে রক্ষায় তারা তৎপর ছিল। হিন্দুদের পক্ষে পাঞ্জাবি শিখ এবং মুসলমানের পক্ষে বিহারি মুসলমানরাই দাঙ্গায় সর্বাধিক ভূমিকা পালন করেছিল। অপরদিকে খাজা নাজিমুদ্দিন বলেছিলেন, ‘আমাদের লড়াই হিন্দুদের বিরুদ্ধে, ব্রিটিশের বিরুদ্ধে নয়।’ হিন্দু মহাসভা প্রধান শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বাংলা প্রদেশে (৫২ শতাংশ মুসলিম এবং ৪৮ শতাংশ হিন্দু) সংখ্যালঘু হিন্দুদের অস্তিত্ব বিপন্নের অভিযোগ তুলে বাংলা ভাগকে নিশ্চিত করেছিলেন। দেশভাগের পেছনে কলকাঠি নেড়েছিল ব্রিটিশ শাসকেরা এবং তাদের ক্রীড়নক হিসেবে ভূমিকা পালন করেছিল হিন্দু ও মুসলিম জাতীয়তাবাদী লীগ ও কংগ্রেসের নেতারা।
আমাদের ইতিহাসের কলঙ্কিত ও নিষ্ঠুরতার এবং শোকের মাস হিসেবেও খ্যাত আগস্ট। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাষ্ট্রপ্রধানসহ তাঁর পরিবার-পরিজনদের নির্মম হত্যাকাণ্ড ঘটে। এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত আওয়ামী লীগ সরকারের দক্ষিণপন্থী কতিপয় সেনাবাহিনীর একটি অংশ ছিল। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র যে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেনি, সেটাও মিথ্যা নয়। এরূপ নৃশংস হত্যাকাণ্ড জাতির ইতিহাসে কখনো ঘটেনি। এই হত্যাকাণ্ড ও ক্ষমতার হাতবদলে মুক্তিযুদ্ধের অর্জনগুলো একে একে বিলুপ্ত করা হয়। রাষ্ট্রক্ষমতার হাতবদল হয় নির্বাচিত সরকারের পরিবর্তে সামরিক সরকারের কাছে। রাষ্ট্রের অনেক মূলনীতির পরিবর্তন ঘটে। নিষিদ্ধ ধর্মভিত্তিক রাজনীতির দুয়ার উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। আমাদের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মৌলিকত্বকেও বিসর্জন দেওয়া হয়। আগস্ট মাসকে শোকের মাস হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছিল। মাসব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হতো। কিন্তু বিগত সরকারের বিদায়ের পর অন্তর্বর্তী সরকারের শাসনামলে দিবসটিকে গুরুত্বহীন করা হয়েছে। যার ধারাবাহিকতা এবারও দেখা যাচ্ছে। অথচ দেশের সমষ্টিগত মানুষ এই নৃশংস ঘটনাকে মেনে নিতে পারেনি। নিয়েছে কেবল মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত স্বাধীনতাবিরোধী চক্র। যাদের পক্ষে সরকারের অবস্থান স্পষ্ট।