
এআই’র প্রতিষেধক এআই’ই
বর্তমান সময়ে অত্যন্ত আলোচিত একটি বিষয় হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তথা এআই। এটি নিয়ে একদিকে যেমন উচ্ছ্বাস রয়েছে, পাশাপাশি এ নিয়ে নেতিবাচক ধারণাও ছড়ানো হচ্ছে। শুরুতেই আমি একটি কথা বলতে চাই, তা হলো, এআই-এর যদি কোনো খারাপ ব্যবহার থেকে থাকে, তাহলে এআই দিয়েই সেটা প্রশমন বা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। যেমন, অশ্লীলতার কথা বলে ইন্টারনেটের ব্যবহার চিরদিনের জন্য বন্ধ করে দিলে আমাদের সমাজ কি উন্নতিসাধনের দিকে চলতে পারবে? বস্তুত, এআই তো একটি প্রযুক্তি ছাড়া আর কিছুই নয়। আমরা যেমন ইন্টারনেট, তথ্যপ্রযুক্তি বা স্মার্ট মোবাইল ফোনের ব্যবহার গ্রহণ করেছি, ঠিক তেমনই আমাদের এআইকেও গ্রহণ করতে হবে।
তথ্যপ্রযুক্তি বলতে আমরা সাধারণত বুঝি, একটি উপায়, যেটা কিনা তথ্যের যথাযথ ব্যবহার, প্রক্রিয়াকরণ, সংরক্ষণ এবং আদান-প্রদানে সাহায্যকারী হিসাবে কাজ করে থাকে। ব্যবসা-বাণিজ্যে কিংবা সরকারের কার্যক্রম পরিচালনায় তথ্যপ্রযুক্তি বিভিন্ন প্রযুক্তির ওপর ভর করে তার একগুচ্ছ কর্মপ্রণালি সম্পাদন করে থাকে। আমাদের এই যুগে, প্রায় সবকিছুই তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সম্পাদন হয়ে থাকে।
এআই বলতে এমন একটি কম্পিউটার সিস্টেমকে বোঝায়, যা সাধারণ মানুষের মতো কাজ করতে বা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। মানুষ যেমন সমস্যা সমাধানে তার চারপাশের সবকিছু দেখে একটি সিদ্ধান্ত নিতে পারে, এআই বা এআইচালিত রোবটগুলোও তেমনিভাবে কাজ করতে সক্ষম। এআই আসলে এমন যে, এটি মানুষের কাজগুলোকে অটোমেশনের মাধ্যমে সফটওয়্যারে বা একসঙ্গে হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যারে রূপান্তরিত করে ফেলে।
আসুন এখন জেনে আসি এর শ্রেণিবিভাগ। এআই সাধারণত তিন ধরনের হয়ে থাকে। প্রথম শ্রেণি বা ধরনটি হলো দুর্বল বা সংকীর্ণ এআই (Weak AI)। এ ধরনের এআই দক্ষতার দিক থেকে খুবই দুর্বল এবং এর কার্যকারিতা সাধারণত স্বাভাবিক নিয়মাবলি সম্পর্কিত কাজের সঙ্গে যুক্ত। যেমন দাবা খেলা বা ইংরেজি থেকে বাংলা বা অন্য যে কোনো অনুবাদ করা। পরের শ্রেণিটাকে বলা হয় জেনারেল বা সাধারণ এআই, যেটি কিনা দুর্বল এআই থেকে একটু বেশি পারদর্শী বলে মনে হতে পারে। কারণ এটি নিজে থেকেই নতুন দক্ষতা শিখতে পারে। এ ধরনের এআই চালনার জন্য মানুষের হস্তক্ষেপ প্রয়োজন পড়ে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে, টেসলা গাড়ির অটোপাইলট ফাংশন মোড। এবার আসা যাক সর্বশেষ এআই-এর শ্রেণিবিভাগ। যেটাকে কিনা অতি বুদ্ধিমান এআই বা সুপার ইন্টেলিজেন্স বলা হয়ে থাকে। এআই চিন্তাবিদদের মতে সুপার ইন্টেলিজেন্স একটি বুদ্ধিমত্তার সর্বোত্তম বা সর্বজনীন রূপের প্রতিনিধিত্ব নাও করতে পারে। কারণ অনেক ক্ষেত্রে এটির ব্যবহার আমাদের অজানা।
আসুন জেনে আসা যাক এআই-এর সবচেয়ে বহুল আলোচিত ও সমালোচিত ব্যবহার। ডিপফেক হলো সাধারণত একটি এআই-এর তৈরি করা মিডিয়া ফাইল, যেমন একটি ছবি, ভিডিও বা অডিও রেকর্ডিং, যা দেখতে আসল বলে মনে হলেও আসলে এটি একটি বানোয়াট কনটেন্ট। ডিপফেক অ্যাপ্লিকেশন একটি নতুন ধারণা, যা ডিজিটাল ব্যবসার জগতে ব্যবহারযোগ্য হলেও সমাজে এটি বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। এআই ব্যবহার করে ডিপফেক কন্টেন্টগুলো সাধারণত ছবি, ভিডিও, অথবা অডিও এবং তাদের সংমিশ্রণ ঘটিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেয়। ডিপফেক বাস্তব বা অস্তিত্বহীন বস্তুভিত্তিক কন্টেন্ট চিত্রিত করে ব্যক্তিবিশেষের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার ক্ষতিসাধন করতে পারে। ডিপফেক কন্টেন্টের মধ্যে মানুষের ছবি বা ছবির মতো কিছু থাকতে পারে, যা কিনা কোনো কিছুর ব্যঙ্গার্থ ব্যবহার ধারণকে বোঝায় বা বোঝাতে পারে। ডিপফেক প্রযুক্তি ব্যবহার করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কোনো কন্টেন্ট বিনোদন এবং সৃজনশীলতার জন্য তৈরি করা যেতে পারে। তবে এটা মনে রাখতে হবে, এটি উল্লেখযোগ্য নৈতিক দ্বন্দ্ব ও উদ্বেগও সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষ করে যখন জনসাধারণের কাছে ভুল তথ্য বা নেতিবাচক বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়। এ কারণেই গবেষকরা ডিজিটাল কন্টেন্ট ব্যবহারের সময় সর্বদা সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন। এর মানে হচ্ছে, যা ডিজিটাল কন্টেন্টে দেখা যায় বা দেখা হয়, এখন এবং সব সময় তা বিশ্বাসযোগ্য নাও হতে পারে।
জাতীয় নির্বাচনে কি এআই কোনো বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে? নির্বাচন জাতির জন্য একটি স্পর্শকাতর বিষয়। ডিপফেক দিয়ে এআই-এর মাধ্যমে যে কোনো প্রার্থীর নৈতিকতা বা চরিত্র নিয়ে জনসাধারণের কাছে ভুল তথ্য বা নেতিবাচক বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া একটি অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাপার। তবে ফেক কন্টেন্ট বা ডিজইনফরমেশন ছড়ানো যেমন একটি প্রত্যাখ্যাত এআই-এর ব্যবহার আমাদের সমাজে বিদ্যমান, তেমনই এর প্রতিকারও এআই-এর মাধ্যমেই সম্ভব।