
ফ্যাসিবাদী প্রধানমন্ত্রীর ধামাধরা উপাচার্য
২০২৪-এর ৫ আগস্ট চূড়ান্ত গণ-অভ্যুত্থানের পর ১ বছর পার হয়ে গেছে। এ উপলক্ষ্যে সরকারি ও বেসরকারিভাবে বিভিন্ন অনুষ্ঠান হয়েছে, শহীদদের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানানো হয়েছে। এবং তাদের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করা হয়েছে। যারা আহত ও পঙ্গু হয়েছেন, তাদের আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে সংবর্ধনা জানানো হয়েছে। এসব অনুষ্ঠানে শহীদদের আপনজন আগস্টের বেদনার কাহিনি বিবৃত করেছেন। তবে সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর বিষয় হলো, আন্দোলনের সময় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার অধস্তন কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তাদের সঙ্গে আন্দোলন দমনের জন্য বলপ্রয়োগের যে নির্দেশনা দিয়েছেন, যা এতদিন জনসমক্ষে আসেনি, তা এখন উন্মোচিত হচ্ছে।
এসবের আগে জাতিসংঘ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল।সেই প্রতিবেদনে জানা গেছে, শেখ হাসিনা পুলিশবাহিনীকে ‘লেথাল ওয়েপন’ ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছিলেন। প্রাণঘাতী বুলেট ও অস্ত্র ব্যবহারের ফলে বহু মানুষের মৃত্যু ঘটে এবং অনেকে মারাত্মকভাবে আহত হয়ে এখন পঙ্গুত্ব নিয়ে বেঁচে আছেন। অনেকে চিকিৎসাধীন থেকে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে মারা গেছেন। হারিয়ে গেছে, পঙ্গু হয়ে গেছে প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের সোনার ছেলেরা। তাদের মধ্যে নিশ্চয়ই এমন অনেকজন ছিলেন, যারা বেঁচে থাকলে অথবা সুস্থ থাকলে দেশের জন্য অবদান রাখতে পারতেন। কেউ কি হলফ করে বলতে পারেন তাদের মধ্যে কেউ নোবেলজয়ী, বিজ্ঞানী বা অর্থনীতিবিদ হতে পারতেন না। আমরা হারিয়েছি বহু অমূল্য মানিক। এ অপূরণীয় ক্ষতি কিছুতেই পূরণ হওয়ার নয়।
সরকারবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রাম দমনের জন্য প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার বহু বছর ধরেই প্রচলিত ছিল। ঔপনিবেশিক আমলে তো বটেই, এমনকি উপনিবেশোত্তর শাসকগোষ্ঠীগুলো আন্দোলন, বিক্ষোভ দমনের জন্য প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার করে চলেছিল। প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহারের জঘন্যতা আমরা দেখতে পেয়েছি ’৭১-এ। ’৭১-পূর্ব সময়ে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ভাষা আন্দোলন, সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন ও উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান দমনের জন্য প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার করেছে। তবে ২৪-এর গণ-অভ্যুত্থান দমনের জন্য শাসকগোষ্ঠীর হিংস্রতার সঙ্গে পূর্বেকার সময়ের হিংস্রতার কোনো তুলনা হয় না। ২৪-এর গণ-অভ্যুত্থানে মাত্র ৩৬ দিনের ব্যবধানে বহু সংখ্যক ছাত্র, শ্রমিক, শিশু ও নারী হতাহত হয়েছে। এ সংখ্যাটা কত, তা আমরা সবাই জানি।
সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে মানবাধিকারের বিষয়টি সামনে চলে আসে। মানুষের জীবন অমূল্য। এ অমূল্য জীবন উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কেড়ে নেওয়ার অধিকার কারও নেই। শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন-বিক্ষোভ করার অধিকার একটি গণতান্ত্রিক অধিকার। এ অধিকারও হরণ করা যায় না। মানবাধিকার নিয়ে আন্তর্জাতিক সচেতনতায় সমৃদ্ধ হয়ে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার মানবতাবিরোধী রূপে চিহ্নিত হয়েছে। বাংলাদেশে আন্দোলন, বিক্ষোভ দমনের জন্য পুলিশের প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের রীতি থেকে খালেদা জিয়ার দ্বিতীয় আমলে সরে আসা হয়। তখনো দু-একটি বিক্ষোভে প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার হয়েছিল। সেই সময় থেকে পুলিশবাহিনীকে রাবার বুলেটসম্পন্ন শটগান ব্যবহার করতে দেওয়া হয়। রাবার বুলেটে আহত হলে প্রাণ যাওয়ার আশঙ্কা অনেক কম। তবে রাবার বুলেটে চোখ বিদ্ধ হলে দৃষ্টিশক্তি হারানোর শঙ্কা থেকেই যায়। অনেক সময় অস্ত্রপাচার করেও শরীর থেকে রাবার বুলেট বের করে আনা সম্ভব হয় না। এ কারণে অনেককে শরীরের মধ্যে রাবার বুলেটের যন্ত্রণা নিয়ে অনেক কষ্টের জীবনযাপন করতে হয়। সুতরাং দেখা যাচ্ছে রাবার বুলেটও কম বিপজ্জনক নয়! এক্ষেত্রে কম বিপজ্জনক কিছু ব্যবহারের তাগিদ দিতে হয়।
সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর ঘটনা হলো শেখ হাসিনার সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এএসএম মাকসুদ কামালের টেলিফোনে কথোপকথন, যা চিফ প্রসিকিউটর ট্রাইব্যুনালে পেশ করেছেন। আন্দোলনকারীদের ফাঁসি দিতে চেয়েছিলেন ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ বিষয়টি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তুলে ধরেছেন চিফ প্রসিকিউটার মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। তার এ বক্তব্যের পক্ষে শেখ হাসিনার সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এএসএম মাকসুদ কামালের টেলিফোন কথোপকথন তুলে ধরেন।
গণ-অভ্যুত্থানের সময় রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় ৬ জনকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সোমবার সূচনা বক্তব্য দেন চিফ প্রসিকিউটর। তার বক্তব্যে কথোপকথনের অডিও রেকর্ডের বিষয়টি তুলে ধরা হয়। শেখ হাসিনার সঙ্গে টেলিফোনে মাকসুদ কামালের কথা হয়েছিল গত বছরের ১৪ জুলাই। ‘প্রত্যেক হল থেকে তো ছেলেমেয়েরা তালা ভেঙে বের হয়ে গেছে। এখন তারা রাজু ভাস্কর্যে, ৪-৫ হাজার ছেলেমেয়ে জমা হইছে। মল চত্বরে জমা হয়েছে এবং যে কোনো মুহূর্তে আমার বাসায়ও অ্যাটাক করতে পারে,’ শেখ হাসিনাকে বলেছেন মাকসুদ কামাল।
- ট্যাগ:
- মতামত
- জুলাই গণঅভ্যুত্থান