
জাতীয় নাগরিক পার্টি-১: মূলধারার দল হয়ে উঠতে পারবে কী?
জুলাই গণআন্দোলনে অংশ নেওয়া ছাত্রদের নেতৃত্বে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি আড়ম্বরপূর্ণ এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল। ৫ অগাস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল গঠিত হলেও এনসিপি ছাড়া আর কোনো দলকে নিয়ে জনমনে তেমন কোনো আগ্রহ তৈরি হয়নি।
এনসিপি নিয়ে আগ্রহের মূল কারণ, জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী ছাত্রদের নিয়ে দলটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতাও পাচ্ছে— রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে এমন একটি ধারণার শক্তিশালী উপস্থিতি। এনসিপির নেতারা বিভিন্ন সময় ‘নয়া রাজনৈতিক বন্দোবস্ত’ এবং ‘দায় ও দরদের’ জায়গা থেকে বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার কথা বলেছেন। এনসিপির নেতারা জোর দিয়ে এটাও বলছেন, তারা যে রাজনীতি করবেন— সেটা হবে পুরোনো বন্দোবস্ত যে রাজনীতির জন্ম দিয়েছে তার থেকে গুণগতভাবে সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং নতুন ধারার।
এসব কিছুর ফলে জন্মলগ্ন থেকেই জনগণ, সিভিল সোসাইটি ও অন্যান্য দলের মধ্যে এনসিপিকে নিয়ে একটা কৌতূহল এবং পর্যবেক্ষণের জায়গা তৈরি হয়েছে। সবাই এটা বুঝতে চাচ্ছে, বাংলাদেশে বিদ্যমান দল, মতাদর্শ, রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং চর্চার বাইরে গিয়ে জাতির সামনে তারা নতুন কী তত্ত্ব এবং চর্চা উপস্থাপনা করতে যাচ্ছে।
উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশের ইতিহাসে অনেক ছোট রাজনৈতিক দল নানা সময়ে চমক সৃষ্টিকারী বক্তব্য এবং স্লোগান নিয়ে হাজির হলেও জনমানসে সাড়া ফেলতে সক্ষম হয়নি। এর কারণ এনসিপির মতো এদের কোনোটাই রাষ্ট্র এবং রাজনীতির কেন্দ্রে অবস্থানকারী দল হিসেবে জনমানসে প্রতিভাত হয়নি।
নিকট অতীতে জাতীয় পার্টিও রাষ্ট্র এবং রাজনীতির কেন্দ্রে অবস্থানকারী দল ছিল। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ক্ষমতার কেন্দ্রে অবস্থান করলেও জাতীয় পার্টি কখনোই মূলধারা হয়ে উঠতে পারেনি। এখন প্রশ্ন হলো, নতুন বন্দোবস্তের কথা বলা এনসিপি কি মূল ধারা বা আদৌ কোনো ধারা হয়ে উঠতে পারবে?
মোটা দাগে বাংলাদেশের রাজনীতিতে চারটি ধারা রয়েছে। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত বাঙালি ও বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী ধারা দুটিই সম্মুখসারিতে রয়েছে। অন্য দুটি ধারার একটি হলো ধর্মভিত্তিক, বিশেষ করে ইসলামবাদী; অন্যটি মার্কসবাদী বা বামপন্থী। বাংলাদেশের সমস্ত দল এ চারটি ধারার কোনো একটিকে ধারণ করেই গড়ে উঠেছে।
আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও সিপিবি হচ্ছে এ চারটি ধারার প্রতিনিধিত্বকারী প্রধান দল। প্রধানতম দুটি ধারার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের মূল রাজনৈতিক দল। বাংলাদেশের জনপরিমণ্ডলের সমস্ত রাজনৈতিক চিন্তাধারা এবং চর্চা মধ্য সত্তরের দশক থেকে এ দুটি দলকে ঘিরেই আবর্তিত হয়েছে।
ধর্মভিত্তিক ও বামপন্থী দলগুলোসহ অন্যান্য দলগুলো হয় এই দুটি দলের সমর্থনে বা বিরোধিতায়, তাদের সঙ্গে জোট গঠন বা জোট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে, অথবা তাদের জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারা দ্বারা কমবেশি প্রভাবিত হয়ে বা তার প্রতিধারণা তৈরি করে নিজেদের বিকশিত ও বিবর্তিত করেছে। ভিন্ন ধারার হলেও গুণগতভাবে ধর্মভিত্তিক ও বামপন্থী দলগুলো স্বাধীন ধারা হিসেবে নিজেদের এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেনি। তাত্ত্বিক এবং চর্চাগত, দু-ভাবেই তারা জাতীয়তাবাদী ধারার ওপর নির্ভরশীল থেকেছে।