
ইউনূস-মোদী বৈঠক: সম্পর্ক তেমন আগায়নি
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ব্যাংককে বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টিসেক্টরাল, টেকনিকাল অ্যান্ড ইকোনমিক কোঅপারেশন (বিমসটেক) সম্মেলন শেষে যে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেছেন– এটা নতুন কোনো খবর নয়। সম্মেলন শেষে ৪০মিনিটের এই বৈঠকে তারা দ্বিপক্ষীয় বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেছেন এবং দুই দেশের কর্মকর্তারা এই বৈঠকে আলোচিত বিষয়বগুলো প্রকাশও করেছেন। যেহেতু বৈঠক শেষে দুই নেতা যৌথ বা এককভাবে কোনো সংবাদ সম্মেলন করেননি, আমাদেরকে সরকারি কর্মকর্তাদের ভাষ্যে এই বৈঠককে মূল্যায়ন করতে হবে।
আলোচনার প্রাধান্য ও শারীরিক ভাষা
এই দুই নেতার বৈঠকে আমরা কিছু কিছু জিনিস লক্ষ্য করতে পারি, যেমন শারীরিক ভাষা ও কোন নেতা কোন কথাগুলোকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন। শুক্রবার বৈঠকের আগে তারা দুজনে হাত মিলিয়ে একে অপরকে স্বাগত জানিয়েছেন, কথা শুরু করার আগে বসে ছবি তুলেছেন। তার আগের দিন বিমসটেক নেতাদের নৈশভোজে তারা দুজন পাশাপাশি বসেছিলেন। এই সব ছবি সংবাদপত্রে ও টিভিতে এসেছে। কূটনীতিতে 'বডি ল্যাঙ্গুয়েজে' বা শারীরিক ভাষাকে অনেক সময় মুখের ভাষার চেয়েও বড় করে দেখা হয়। মোদী ও ইউনূস দুজনই অনেক বছর ধরে বিশ্বমঞ্চে নানান দেশের নেতাদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ ও আলাপ-আলোচনায় আলো ছড়িয়েছেন। কিন্তু এবার তাদের দুজনের শারীরিক ভাষাকে আমার কাছে খুব উষ্ণ মনে হয়নি, এমনটা আমার একার কাছে মনে হয়েছে তা নয়, আরও অনেকেই বলেছেন এই কথা।
বৈঠক শেষে প্রথম দিকেই বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে যে খবর আসে তাহলো, বৈঠকে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ চেয়েছেন ড. ইউনূস। বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করতে শেখ হাসিনা বিভিন্ন মাধ্যমে ‘যে বিদ্বেষমূলক মন্তব্য করে আসছেন’, সেটা বন্ধ করতে অনুরোধও করেছেন তিনি। অপরদিকে, ভারতীয় পত্রিকাগুলোতে যে সংবাদকে সর্বপ্রথম প্রধান্য দেয়া হয় তা হলো, ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদী বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার অনুরোধ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা ইউনূসকে। ভারতের ইংরেজি সংবাদপত্র 'দ্য টাইমস অফ ইন্ডিয়া' এই দুই নেতার আলোচনার ভিন্ন দুটি প্রাধান্য বিষয়কে একই শিরোনামে এভাবে প্রকাশ করেছে– ‘সংখালঘুদেরকে নিরাপত্তা দিন’: মোদী, ‘হাসিনাকে সামলান’: ইউনূস। আলোচনার অন্যান্য বিষয়গুলোও ক্রমান্বয়ে প্রকাশ পায়। সমস্ত আলোচনাটা পুরাপুরি পর্যালোচনা করলে মনে হবে, মোদী ও ইউনূস– দুই নেতাই নিজ নিজ দেশের সমর্থক ও জনগোষ্ঠীকে সন্তুষ্ট করার জন্য বেশ কিছু বিষয় তুলে ধরেছেন এবং সঙ্গে কিছু কিছু সতর্কবাণীও উচ্চারণ করেছেন।
আলোচনার বিষয়বস্তু
বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে অনুষ্ঠিত দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পরে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম ‘একটা গঠনমূলক, বস্তুনিষ্ঠ এবং ফলপ্রসূ’ বৈঠক হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন। মুহাম্মদ ইউনূস সীমান্ত হত্যা, গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তির নবায়ন, তিস্তা চুক্তি সইসহ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করেছেন, এ তথ্য দিয়েছেন প্রেস সচিব। তিনি আরো বলেছেন, শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠানো নিয়ে মুহাম্মদ ইউনূস আলোচনা উত্থাপন করলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর প্রতিক্রিয়া নেতিবাচক ছিল না। এই ব্যাপারে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রী বলেছেন, “তারা শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠাবার কথা বলেছেন, কিন্তু এই ব্যাপারে আমাদের এখন ‘অতিরিক্ত কিছু বলার নেই।” বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন , “দেখুন, বিষয়টি উত্থাপিত হয়েছে, এটা নিয়ে চূড়ান্ত কিছু হয় নাই। আমি এটুকুই বলব।”
প্রধানমন্ত্রী মোদী ‘একটি গণতান্ত্রিক, স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ, প্রগতিশীল এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশের প্রতি ভারতের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছেন' বলে বললেন মিশ্রী । মিশ্রী আরো বলেন, ভারতীয় নেতা ‘বাস্তববাদের চেতনার ভিত্তিতে বাংলাদেশের সঙ্গে একটি ইতিবাচক এবং গঠনমূলক সম্পর্কের’ জন্য নয়াদিল্লির আকাঙ্ক্ষার ওপরও জোর দিয়েছেন।
এইসব বিষয়গুলোকে পর্যালোচনা করলে মনে হবে, তাদের দুজনের যা বলার তারা তা শুধু বলে গেছেন। কিন্তু এইসব ব্যাপারগুলো সুরাহা করার ব্যাপারে কোনো ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ বা কার্যক্রম গ্রহণ করেননি।
দূরত্ব রয়েই গেল
৪০ মিনিট খুব বেশি সময় নয়, তবে এতে জমে যাওয়া বরফ গলতে শুরু করেছে বলে মনে করা হচ্ছিল। কিন্তু ইউনূস-মোদী বৈঠক যে খুব ফলপ্রসূ হয়নি, তা বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করল ভারত।
ভারতের সেন্ট্রাল বোর্ড অব ইনডিরেক্ট ট্যাক্সেস অ্যান্ড কাস্টমস (সিবিআইসি) মঙ্গলবার এক সার্কুলারে এই সিদ্ধান্ত জানিয়েছে। ওই সার্কুলারে ২০২০ সালের ২৯ জুনের একটি সার্কুলার ‘অবিলম্বে’ বাতিল করার কথা বলা হয়েছে। পুরনো ওই সার্কুলারে বলা ছিল, বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি পণ্য কনটেইনার বা কভার্ড ভ্যানের মাধ্যমে তৃতীয় দেশে পাঠানোর ক্ষেত্রে ভারতের স্থল শুল্ক স্টেশন থেকে দেশটির অন্য কোনো বন্দর বা বিমানবন্দর পর্যন্ত ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা পাবে।