
ইউনূস-মোদি বৈঠকের ফলাফল কী
নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠক বা দেখাসাক্ষাৎ আয়োজনের চেষ্টা বাংলাদেশ বেশ কিছুদিন ধরেই করে যাচ্ছিল। ভারতের তরফে সাড়া পাওয়া যায়নি। গত সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের সময় বাংলাদেশের তরফে এমন চেষ্টার উদ্যোগ ছিল। মার্চে মুহাম্মদ ইউনূসের চীন সফরের আগে মোদির সঙ্গে বৈঠক হোক, সেই চেষ্টাও বাংলাদেশ করেছে, ভারত রা করেনি।
এরপর ব্যাংককে বিমসটেক সম্মেলনের ফাঁকে এমন একটি বৈঠক অনুষ্ঠানের জন্য বাংলাদেশ ভারতকে অনুরোধ করে। শুরুতে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিবৃতি দিয়ে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত বৈঠকটি হয়েছে। ভারত বৈঠকে বসতে বাধ্য হয়েছে, বিষয়টি নিশ্চয়ই তা নয়, কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী মোদি অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে বসেছেন।
গত ৫ আগস্ট হাসিনার পতনের পর ভারত যে অবস্থান নিয়েছে, তাতে এটা মনে হওয়া স্বাভাবিক যে বাংলাদেশের জনগণ তাদের ওপর চেপে বসা দীর্ঘদিনের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটিয়ে যেন বিশাল এক অপরাধ করে ফেলেছে। অথচ ব্যাপারটি হওয়ার কথা ছিল উল্টো। কারণ, ভারত বাংলাদেশে এই স্বৈরশাসন টিকিয়ে রাখতে সরাসরি প্রভাব খাটিয়েছে।
৯ মাস ধরে ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুরাষ্ট্রের মতো আচরণ করছে না। কারণ, শেখ হাসিনার পতনকে ভারত তাদের পররাষ্ট্রনীতি ও কৌশলের সমস্যা বা ভুল হিসেবে বিবেচনা না করে সম্ভবত পরাজয় হিসেবে দেখছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ভারতের এই বোধোদয় হচ্ছে না যে বাংলাদেশ বা বাংলাদেশের জনগণের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষাকে উপেক্ষা একটি দল ও সেই দলের একজন নেতার ওপর ভরসা করা তাদের ঠিক হয়নি। কোনো বড় রাষ্ট্রের এ ধরনের পররাষ্ট্রনীতি বা কৌশল নেওয়ার নজির দেখা যায় না। বাংলাদেশে স্বৈরশাসন টিকিয়ে রাখার নীতি যে তাদের ভুল ছিল, তা ভারত বুঝতে পেরেছে বলেও মনে হয় না।
শেখ হাসিনার পতনের পর তাই তারা উল্টো শক্ত অবস্থান নিয়েছে। বাংলাদেশের নাগরিকদের তারা ভিসা দেওয়া বন্ধ রেখেছে। চিকিৎসার জন্য যারা ভারতে যায়, তাদের জন্যও ভিসা পাওয়া কঠিন হয়ে গেছে। দুই দেশের মধ্যে সরাসরি বাস ও ট্রেন যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে ভারতজুড়ে শুরু হয় বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা। দেশটির অধিকাংশ সংবাদমাধ্যমও এর অংশ হয়ে পড়ে।
ভারতের এই রাষ্ট্রীয় অবস্থান সেখানকার জনতুষ্টিবাদী, জাতীয়তাবাদী বা হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির পালে হাওয়া দিচ্ছি ঠিকই, কিন্তু একটি আঞ্চলিক পরাশক্তি হিসেবে এর মধ্য দিয়ে ভারত কূটনৈতিকভাবে কতটা লাভবান হবে, ভবিষ্যৎই তা বলে দেবে।
অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের এমন আচরণের পরও বাংলাদেশ কেন ইউনূস-মোদি বৈঠকে জন্য এতটা তৎপর ছিল, সেই প্রশ্ন কেউ তুলতে পারেন। ভারতে যেমন বাংলাদেশ বিরোধিতা বেড়েছে, বাংলাদেশেও ভারত বিরোধিতা বেড়েছে। এমন একটি পরিস্থিতিতে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করার জন্য রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বাংলাদেশ যে সদিচ্ছা দেখাচ্ছে ও উদ্যোগ নিয়েছে, কূটনৈতিক বিবেচনায় তাকে পরিপক্ব অবস্থান হিসেবেই বিবেচনা করতে হবে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ইউনূস-মোদি বৈঠকের ফলাফল কী? বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক যখন সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় চলে এসেছে, তখন এই দুজন একটি বৈঠকে বসেছেন, এটাই সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। বাংলাদেশের দিক থেকে দেখলে বলতে হয়, এই বৈঠক হয়েছে বাংলাদেশের আগ্রহ ও চেষ্টার ফল হিসেবে এবং এর মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলাদেশের সদিচ্ছার প্রমাণ দেওয়া গেছে।